আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০-১২৫৮খ্রি.)
ভূমিকা
আব্বাসীয় শাসনের সূত্রপাত হয় উমাইয়া খিলাফতের পতনের পর। যারা ৭৫০ থেকে ১২৫৮ পর্যন্ত সুদীর্ঘ কাল শাসন ক্ষমতায় ছিল। এই সময়টি ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। মুসলিম সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশে এই বংশ এক মাইলফলক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এটি ছিল মূলত ইসলামী কৃষ্টি, সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক যুগ। এই বংশে সর্বমোট ৩৭ জন খলীফার আবির্ভাব ঘটেছে। উমাইয়া খিলাফতকাল ছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে একক আধিপত্যের যুগ, কিন্তু আব্বাসীয় শাসনকালের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মুসলিম খিলাফত ৩টি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসীয় খিলাফত, মিসরের কায়রোয়ান কেন্দ্রিক ফাতিমীয় খিলাফত ও স্পেনের কর্ডোভা কেন্দ্ৰিক উমাইয়া খিলাফত। এছাড়া এই বংশের শেষ দিকে দুর্বল সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তির কারণে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের উদ্ভব ঘটে যা এই শাসনামলের একটি গুণগত বৈশিষ্ট্য। এতে আরব অনারব দ্বন্দ্ব ছিল না। একক আরবীয় জাতীয়তাবাদের স্থলে বিশ্বজনীন মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে। আরবীয়দের স্থলে পারসিকদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। কেন্দ্ৰীয় শাসনে খলীফার পর উযির পদ্ধতির প্রথম সূচনা। বাগদাদ পরিণত হয় মুসলিম রাজনীতি, শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে।
সাম্রাজ্য বিস্তারের যুগকে পেছনে ফেলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে মুসলিমগণ এই খিলাফতের মাধ্যমে প্রবেশ করে। ৫০৮ বছর শাসন করে আব্বাসীয় খিলাফত পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘস্থায়ী শাসনকালের ইতিহাস গড়ে। আবুল আব্বাস আস-সাফফার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বংশ আবু জাফর আল মনসুর, হারুন অর-রশীদ ও আল-মামুনের মত শ্রেষ্ঠ খলীফাদের মাধ্যমে ইতিহাসে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম। অবশেষে ১২৫৮ খ্রি: হালাকু খান কর্তৃক বর্বরোচিত আক্রমণে সর্বশেষ খলীফা আল মুসতাসিম বিল্লাহর হত্যার মধ্য দিয়ে এই খিলাফতের অবসান ঘটে। এই ইউনিটে আব্বাসীয় আমলে খলিফাদের ক্ষমতায় আরোহণ, তাঁদের চরিত্র, কৃতিত্ব ও আনীত সংস্কারসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
এই ইউনিটের পাঠসমূহ
পাঠ-৮.১ : আব্বাসীয় আন্দোলন ও বংশ প্রতিষ্ঠা
পাঠ-৮.২ : আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ
পাঠ-৮.৩ : আবু জাফর আল মনসুর এর শাসনব্যবস্থা পাঠ-৮.৪ : আবু জাফর আল মনসুর এর চরিত্র ও কৃতিত্ব
পাঠ-৮.৫ : আল-মাহদী ও আল-হাদী
পাঠ-৮.৬ : হারুন-অর-রশিদের খিলাফত লাভ এবং তাঁর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি
পাঠ-৮.৭ : হারুন-অর-রশীদের চরিত্র ও কৃতিত্ব
পাঠ-৮.৮ : খলীফা আল-আমীন ও আল-মামুনের মধ্যকার গৃহযুদ্ধের কারণ,
পাঠ-৮.৯ : আল-মামুনের শাসন ব্যবস্থা
পাঠ-৮.১০ : আল-মামুনের শাসন আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি
পাঠ-৮.১১ : আল-মুতাসিম বিল্লাহ, আল-ওয়াসিক ও আল-মুতাওয়াক্কিল
পাঠ-৮.১২ : বুয়াইয়া বংশের উত্থান ও পতন পাঠ-৮.১৩ : সেলজুক বংশের উত্থান ও পতন
পাঠ-৮.১৪ : আব্বাসীয় বংশের পতন
পাঠ-৮.১৩ : আব্বাসীয় সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি
পাঠ-৮.১
আব্বাসীয় আন্দোলন ও বংশ প্রতিষ্ঠা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি -
আব্বাসীয়দের পরিচয় জানতে পারবেন।
আব্বাসীয় আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে পারবেন। আব্বাসীয় বংশ ও খিলাফতের প্রতিষ্ঠা বর্ণনা করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
হাদীসবেত্তা, স্বপ্নদ্রষ্টা, মাওয়ালী মুসলিম, আবু মুসলিম খোরাসানী, আস-সাফফা, জাবের যুদ্ধ, কুসাফ গ্রাম ও বাগদাদ
নামকরণ ও পরিচয়
আব্বাসীয় খিলাফতের নামকরণ হয়েছে মহানবী (সাঃ) এর চাচা আল-আব্বাসের নাম হতে। তাঁর নামানুসারে এই বংশের নামকরণ হয়েছে আব্বাসীয় বংশ। তিনি আল-আব্বাস আব্দুল্লাহ, ফজল, উবায়দুল্লাহ ও কায়সার নামে ৪ পুত্র রেখে ৩২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তারা প্রত্যেকেই হযরত আলী (রা.) এর পক্ষ অবলম্বন করেন। আব্দুল্লাহ ইতিহাসে ‘ইবনে আব্বাস’ নামে পরিচিত। তিনি একজন প্রখ্যাত হাদীসবেত্তা ছিলেন। ইমাম হুসাইন (রা.) কারবালার যুদ্ধে নিহত হলে তিনি ভগ্নহৃদয়ে ৬৮৭ খ্রি. ৭০ বছর বয়সে তারিফে ইন্তিকাল করেন। এরপর তাঁর পুত্র আলী পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আব্বাসীয় আন্দোলনের উৎপত্তি
৭৩৫ খ্রি: আলী (রা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুহাম্মদ পরিবারের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। মুহাম্মদ অতিশয় উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং তিনিই ছিলেন আব্বাসীয় আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি সর্বপ্রথম রাজক্ষমতা দখলের ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি নিজেকে খিলাফতের ন্যায্য দাবিদার ভাবতেন।
হযরত ফাতিমা (রা.) এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (রা.) হানাফিয়া গোত্রের জনৈকা রমণীকে বিবাহ করেন এবং মুহাম্মদ আল-হানাফীয়া তাঁর গর্ভজাত পুত্র ছিলেন। কারবালার ঘটনায় ইমাম হুসাইন (রা.) এর মৃত্যুর পর ইসলামের ধর্মীয় নেতৃত্ব ইবনুল হানাফিয়ার হাতে অর্পিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হাশিম নেতৃত্ব লাভ করেন। হাশিম তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ইবনে আব্বাসের প্রপৌত্র মুহাম্মদকে ধর্মীয় নেতৃত্ব অর্পন করেন। মুহাম্মদ তাঁর ইচ্ছা বাস্তবায়নের পূর্বেই ৭৪৪ খ্রি: মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তদ্বীয় ৩ পুত্র ইব্রাহিম, আবুল আব্বাস ও আবু জাফরকে পরপর তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যান ।
সমর্থন ও অনুকূল পরিবেশ
আবুল আব্বাসের বংশধরগণ ছিলেন হাশিমী গোত্রভুক্ত ও মহানবী (সাঃ) এর নিকটাত্মীয়। তাই Ahl al-Bayt এর পাশে তাদের এই আন্দোলনকে জনগণ স্বাগত জানায়। বিশেষ করে শিয়া মুসলিম ব্যাপকভাবে তাদের সমর্থন জানায়। উমাইয়া শাসনের কুপ্রভাব, কারবালার ঘটনা, আরব-অনারব বৈষম্য, গোত্রীয় দ্বন্দ্ব ইত্যাদি উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে জনমনে বীতশ্রদ্ধা সৃষ্টি হয়। তারা এই শাসনের সমাপ্তি কামনা করে । পারস্য অঞ্চলের মাওয়ালী মুসলিম ও সুন্নী মুসলিমগণের মনে উমাইয়াদের নৈতিক অধঃপতন ও ইসলাম হতে বিচ্যুতি ও বৈষম্যমূলক আচরণ হতে পরিত্রাণ পাবার আশায় আহলে বায়াতের নামে এই আব্বাসীয় আন্দোলনকে স্বাগত জানায়। এভাবে আব্বাসী আন্দোলন সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে একটি সর্বজনীন রূপ লাভ করে।
আবু মুসলিমের আবির্ভাব
মূলত উমাইয়া খলীফা দ্বিতীয় ইয়াজিদের সময় হতেই এই আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। এর ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়। হিশামের মৃত্যুর পর এই আন্দোলন আরো জোরদার হয় এবং দ্বিতীয় মারওয়ানের শাসনামলে তা তীব্র আকার ধারণ করে ।
ইব্রাহীম এই সময় আব্বাসীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সৌভাগ্যক্রমে এই সময় আবু মুসলিম খোরাসানী নামক আরব বংশোদ্ভূত ইস্পাহানবাসীর আবির্ভাব ঘটে যিনি নিজেকে আব্বাসীয় প্রচার কাজে সম্পৃক্ত করেন। তিনি একজন দক্ষ সামরিক সংগঠক ও কৌশলী সেনানায়ক ছিলেন। তিনি খোরাসান অঞ্চলে আব্বাসীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হন।
খোরাসান দখল
খোরাসান অঞ্চলে ব্যাপক প্রচার অভিযানের ফলে আবু মুসলিম খোরাসানী ব্যাপক সমর্থন লাভ করেন। এর মধ্যে খারিজী, শিয়া ও মাওয়ালীদের সমর্থন ছিল উল্লেখযোগ্য। খোরাসান আব্বাসী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়। খলীফা মারওয়ান তখন সিরিয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। খোরাসানের সর্বশেষ উমাইয়া গভর্ণর নসর বিন সাইয়্যার কিরমানের খারিজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগে আবু মুসলিম খোরাসানের রাজধানী মার্ভ দখল করেন (৪৭৭ খ্রিঃ)। নসর আবু মুসলিমের সেনাপতি কাহতাবা কর্তৃক পরাজিত হন ও মারওয়ান কর্তৃক প্রেরিত সাহায্য পৌছাবার পূর্বে নসর পলায়নরত অবস্থায় নিহত হন। এভাবে খোরাসান আব্বাসীদের হস্তগত হয়।
ইব্রাহিমের কারাবরণ
খলীফা মারওয়ান আব্বাসীয় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হিসেবে ইব্রাহিমকে বন্দী করেও কারাগারে পাঠান। তবুও সমানগতিতে এই আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে। আবু মুসলিমের সেনাপতি কাহতাবা ও খালিদ ইউফ্রেটিস নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে উমাইয়া সেনাপতি ইয়াজিদকে পরাজিত করেন। যুদ্ধে ইয়াজিদ পরাজিত হন, কাহতাবা নিহত হলে তাঁর পুত্র হাসান আব্বাসী বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। আবু মুসলিমদের অপর সেনাপতি আবু আয়ান মারওয়ানের পুত্র আব্দুল্লাহকে পরাজিত করে নিহাওয়ান্দ ও মেসোপটেমিয়া অধিকার করেন। এই সংবাদ পেয়ে মারওয়ান ইব্রাহীমকে হত্যার নির্দেশ দেন। ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর আবুল আব্বাস আস-সাফফা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
আবুল আব্বাসের খিলাফত ঘোষণা
ইব্রাহীমের বন্দী অবস্থায় তাঁর ভ্রাতাগণ কুফায় আত্মগোপন করেন এবং ইবনে কাহতাবা কর্তৃক কুফা অধিকৃত হওয়া পর্যন্ত তারা আত্মগোপনে থাকেন। ৭৪৯ খ্রি: কুফা বিজিত হয় এবং আবুল আব্বাস কুফার মসজিতে খলীফা হিসেবে ঘোষিত হন। ইরাকবাসী এতে পূর্ণ সমর্থন জানায় ও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে।
যাবের যুদ্ধ
খলীফা দ্বিতীয় মারওয়ান তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেন আব্বাসীয়দের প্রতিহত করতে। ১,২০,০০০ সৈন্য সমেত তিনি টাইগ্রিস নদী অতিক্রম করে জাব নদীর তীরে অগ্রসর হন। আব্বাসীয় বাহিনী আবুল আব্বাসের পিতৃব্য আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে সমবেত হয়। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী জাব নদীর তীরে কুসাফ নামক গ্রামে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মারওয়ান শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং মসুল, হাররান হয়ে দামেস্কে পলায়ন করেন। সেখান হতে প্যালেস্টাইন হয়ে মিসরের দিকে পলায়ন করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি ধৃত এবং নিহত হন। তাঁর মস্তক কুফায় আব্দুল আব্বাসের নিকট প্রেরণ করা হয়। খলীফা মারওয়ানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উমাইয়া বংশ বিলুপ্ত হয় এবং আব্বাসীয়গণ খিলাফতে অধিষ্ঠিত হন।
সারসংক্ষেপ:
ইবনে আব্বাসের বংশধরগণ মহানবী (সাঃ) ও বিবি ফাতিমার বংশধরগণের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার সুযোগ গ্রহণ করে উমাইয়া বিরোধী প্রচারণা করেন এবং উমাইয়া খিলাফত অবসানে সর্বাত্মক আন্দোলন পরিচালনা করেন। এই আন্দোলন সফলতার পেছনে আবু মুসলিম খোরাসানীর অবদান অপরিমেয়। তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাধর, মেধাবী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা। অবশেষে ৭৫০ খ্রি: ২য় জাবের যুদ্ধের মাধ্যমে দামেস্ক কেন্দ্রিক উমাইয়া বংশের পতন ঘটে এবং তদস্থলে প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসীয় বংশ।
পাঠ-৮.২
আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
আবুল আব্বাস এর পরিচয় বলতে পারবেন।
আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠায় আবুল আব্বাসের ভূমিকা বর্ণনা করতে পারবেন। আবুল আব্বাসের চরিত্র ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
উত্তরসূরী, রক্তপিপাসু, নিধনযজ্ঞ, ‘আল হাশিমীয়া' ও উযীর, জল্লাদ
পরিচয় ও সিংহাসনে আরোহণ
আবুল আব্বাস ছিলেন আব্বাসীয় বংশের প্রথম খলীফা। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। তিনি ছিলেন রাসূল (সাঃ) এর অন্যতম চাচা আল আব্বাস এর উত্তরসূরী। জাব নদীর তীরে ৭৫০ খ্রিঃ আব্দুল্লাহর নিকট উমাইয়া বংশের শেষ খলীফা দ্বিতীয় মারওয়ানের পরাজয়ের মাধ্যমে আব্বাসীয়গণ ক্ষমতা লাভ করে। কুফার জামে মসজিদে আবুল আব্বাস খলীফা হিসেবে ঘোষিত হন এবং জনগণ তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে । তিনি আস-সাফফাহ বা রক্তপিপাসু উপাধি গ্রহণ করেন ।
উমাইয়া নিধনযজ্ঞ
এরপর আব্বাসীয়গণ উমাইয়া বংশকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। আস-সাফফাহর পিতৃব্য আব্দুল্লাহ প্যালেস্টাইনের আবু ফ্রুটস নামক স্থানে ৮০ জন উমাইয়া বংশের লোককে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। সেখানে যত উমাইয়া বংশীয় লোক ছিল সকলকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এমনকি মৃত উমাইয়াদের দেহ কবর হতে তুলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। কেবলমাত্র মুয়াবিয়া ও দ্বিতীয় উমরের কবর এই নিষ্ঠুরতার হাত হতে রক্ষা পায়। এই নিষ্ঠুর আচরণের ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানের উমাইয়া সমর্থকগণ বিশেষ করে দামেস্ক, হিমস, কিনিসিরিন, ফিলিস্তিন এর লোকজন নিজেদের দাড়িগোঁফ কামিয়ে আব্বাসী বংশের বিরোধিতা করে। আস-সাফফাহ অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে এই সকল বিদ্রোহ দমন করেন।
ইয়াজিদ বিন হুবায়রার পতন
২য় মারওয়ানের মৃত্যুর পরও ইরাকের শাসনকর্তা ইয়াজিদ বিন হুবায়রা ওয়াসিতে নিজ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান নামক জনৈক ব্যক্তিকে হযরত আলীর বংশধর হিসেব খলীফা ঘোষণা করেন। এই সময় আবুল আব্বাস ইয়াজিদকে দমন করার জন্য তাঁর ভ্রাতা আবু জাফর ও সেনাপতি কাহতাবা কে প্রেরণ করেন। ইয়াজিদ দীর্ঘ ১১ মাস অবরুদ্ধ থাকার পর প্রাণরক্ষার প্রতিশ্রুতিতে আত্মসমর্পন করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর পুত্র ও বহু অনুচরসহ নিহত হন।
রাজধানী স্থানান্তর
আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ তাঁর রাজধানী ইরাকের কুফা হতে আল-আনবারে স্থানান্তরিত করেন। সেখানে তিনি ‘আল হাশিমীয়া' নামক একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন ।
প্রশাসনিক কর্তা নিয়োগ
আবুল আব্বাস খলীফা হওয়ার পর প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁর নিকটাত্মীয় ও সমর্থকদের নিয়োগ করেন। এতে তাঁর প্রশাসনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। খলীফা তাঁর ভ্রাতা আবু জাফরকে মেসোপটেমিয়ায়, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের শাসনকর্তা; পিতৃব্য দাউদ ইবনে আলীকে হিজায, ইয়ামেন ও ইয়ামামায়, আব্দুল্লাহ ইবনে আলীকে সিরিয়ায়, সুলাইমান ইবনে আলীকে বসরায়; আবু মুসলিমকে খোরাসানের এবং আয়ুনকে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। খালিদ ইবনে বার্মাককে অর্থমন্ত্রী ও আবু সালমা খাল্লালকে উযীর হিসেবে নিযুক্ত করেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকারী মনোনয়ন
চার বছর তিন মাস রাজত্ব করার পর ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ ৩০ বছর বয়সে বসন্ত রোগে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর ভ্রাতা আবু জাফরকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান এবং ভ্রাতুষ্পুত্র ঈশাকে তৎপরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। আস-সাফফাহ এক পুত্র মুহাম্মদ ও রাইতা নামক এক কন্যা রেখে যান। পরবর্তীতে আল-মাহদীর সাথে রাইতার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল।
চরিত্র ও কৃতিত্ব
নিজ বংশের স্বার্থে আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ একজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন। উমাইয়াদের প্রতি নৃশংস ও নির্মম আচরণ তাকে ইতিহাসে রক্ত পিপাসু স্বীকৃতি দেয়। এসকল নিষ্ঠুরতার উর্ধ্বে তিনি ছিলেন একজন দারুণ সামরিক সংগঠক, দক্ষ সৈনিক ও কর্তব্যপরায়ণ শাসক। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ছিল নিষ্কলুষ। তিনি মাত্র একজন স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন (উম্মে সালমা)। খলীফা তাঁর স্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত অনুরুক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্য ও আত্মীস্বজনকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন। এতে তিনি পরিবারের সদস্যদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সমর্থ হন। তিনি কুফা হতে আনবারে রাজধানী স্থাপন করেন। আব্বাসীদের জন্য একটি নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি করেন। তিনি অট্টালিকা, রাজপ্রাসাদ, কুফা হতে মদিনা পর্যন্ত দীর্ঘ জনপথ তৈরি করেন এবং হজ্বযাত্রীদের সুবিধার জন্য তিনি এর স্থানে স্থানে সরাইখানা নির্মাণ করেন। আব্বাসীয় প্রশাসন ব্যবস্থায় উযির ও জল্লাদের পদ তিনি প্রথম সূচনা করেন। তিনি একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
সারসংক্ষেপ:
মূলত তাঁর বংশের প্রতি উমাইয়াদের নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিশোধ হিসেবেই আবুল আব্বাস উমাইয়াদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলেন। তিনিই ছিলেন আব্বাসীয় বংশের প্রথম খলীফা। অতি স্বল্প রাজত্বকালের মধ্যে তিনি রাজধানী স্থাপন, প্রশাসনিক নিয়োগ ও উমাইয়া বিদ্রোহ দমন করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
পাঠ-৮.৩
আবু জাফর আল মনসুর এর শাসনব্যবস্থা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি -
আল-মনসুরের পরিচয় ও খিলাফত লাভ সম্পর্কে বলতে পারবেন। আব্বাসীয় শাসন সুদৃঢ়করণে তাঁর ভূমিকা বিবরণ দিতে পারবেন।
আল মনসুরের শাসনব্যবস্থা কেমন ছিল তাঁর বিবরণ দিতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
পরিচয়
আল মনসুর (বিজয়), প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা, ‘দারুস-সালম’,স্বাধীন আল-আমিরাত, দলপতি
সানবাদ, রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়, খালিদ বিন বার্মাক ও ‘নফস উস-জাকিয়া’
আবু জাফর আল মনসুর ছিলেন আব্বাসীয় বংশের প্রথম খলীফা আবুল আব্বাস আস-সাফফাহর জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা। তাঁর নাম ছিল আবু জাফর। সিংহাসনে আরোহণ করে তিনি আল মনসুর (বিজয়) উপাধি গ্রহণ করেন। ইতিহাসে তিনি এই নামেই অধিক পরিচিত।
খিলাফত লাভ
আবুল আব্বাস ৭৫৪ খ্রি: মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর ভ্রাতা আবু জাফরকে সিংহাসনের জন্য মনোনীত করে যান। এই সময় আবু জাফর মক্কায় হজ্ব পালনে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি দ্রুত কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
অভ্যন্তরীণ নীতি
আবুল আব্বাস যদি আব্বাসীয় বংশের প্রতিষ্ঠাতা হন তাহলে আবু জাফর আল মনসুর ছিলেন এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শাসন ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করেছিলেন, বিদ্রোহ দমন করেন এবং সুন্নী ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শাসনপ্রণালীতে ধর্মীয় ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটান। তিনি তাঁর বংশের স্বার্থ রক্ষার্থে তাঁর শত্রু মিত্র উভয়কেই সমান নজরে দেখতেন।
আব্দুল্লাহর বিদ্রোহ দমন
আল মনসুরের খিলাফত লাভের পর তাঁর চাচা সিরিয়ার শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কারণ আবুল আব্বাসের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জাবের যুদ্ধে যিনি বিজয়ী হবেন তিনি পরবর্তীতে খিলাফতের অধিকারী। কিন্তু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ফলে আব্দুল্লাহ বিদ্রোহী হন। আল-মনসুর আবু মুসলিমকে আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। ৭৫৪ খ্রি: নাসিবিনের যুদ্ধে আবু মুসলিম আব্দুল্লাহকে এক তুমূল যুদ্ধে পরাজিত করেন। আব্দুল্লাহ বসরায় তাঁর ভ্রাতা সুলায়মানের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে আব্দুল্লাহ তাঁর পুত্রসহ হাশিমীয়ার অনতিদূরে একটি দুর্গে কারারুদ্ধ হন। সাত বছর বন্দী থাকার পর তাকে লবণের ভিত্তির উপরে নির্মিত একটি প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু একদিন প্রবল বর্ষণে বাড়িটি ধ্বসে পড়ে ও আব্দুল্লাহ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে নিহত হন।
আবু মুসলিমের পতন
আবু মুসলিম খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। তাই তিনি ভবিষ্যতে খিলাফতের প্রতি হুমকি স্বরূপ হওয়ার পূর্বেই তাকে দমনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। আবু মুসলিমকে আল মনসুর রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানান। তাঁর সাথে উচ্চবাক্যের পর কৌশলে তাকে গুপ্তঘাতক দ্বারা হত্যা করেন। আবু মুসলিম ছিলেন আব্বাসী বংশের ‘Kingmaker’, একজন অসাধারণ সামরিক সংগঠক। তিনি প্রায় ৬ লক্ষ উমাইয়াকে প্রাণে হত্যা করেছিলেন। তাই ভবিষ্যতের হুমকি মনে করে আল মনসুর তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
সানবাদের বিদ্রোহ দমন
আবু মুসলিমের পতনের পরে পারস্য ও খোরাসান অঞ্চলে তাঁর অনুচর ও সমর্থকগণ ব্যাপক বিদ্রোহ সৃষ্টি করে। এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন মাজুনি দলপতি সানবাদ। খলীফা আল মনসুর খোরাসানের বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। যুদ্ধে সানবাদ নিহত হন। এরপর খোরসান অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় আবু মুসলিমের অপর একজন সেনাপতি আবু নাসের খলীফার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং খলীফা তাকে ক্ষমা করে দেন।
রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়কে দমন
পারস্যের রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায় আল মনসুরকে ‘আল্লাহর অবতার’ বলে গণ্য করত। তারা উগ্রপন্থী ছিল এবং ধর্মবিরোধী কার্যকলাপের জন্য খলীফা ৭৫৮ খ্রি: ২০০ জন রাওয়ান্দিয়াকে বন্দী করেন। এর কিছুদিন পর এই সম্প্রদায়ের প্রায় ৬০০ লোক খলীফার সাথে রাজদরবারে দেখা করতে এসে খলীফাকে আক্রমণ করে। এই সময় মায়ান বিন যায়দার হস্তক্ষেপের ফলে খলীফা রক্ষা পান। পরবর্তীতে খলীফা রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়কে কঠোর হস্তে দমন করেন।
তাবারিস্তান ও খোরাসানের বিদ্রোহ দমন
রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়কে দমনের পর ৭৫৯ খ্রি: খোরাসানের শাসনকর্তা খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । এই বিদ্রোহ দমনের জন্য খলীফা তাঁর পুত্র আল-মাহদী ও সেনাপতি খুযাইমাকে প্রেরণ করেন। বিদ্রোহীদের নেতা পলায়ন করেন এবং এতে বিদ্রোহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে খোরাসানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর তাবারিস্তানের শাসনকর্তা ইস্পাহান্দা বিদ্রোহী হলে আল-মাহদী তাকেও পরাজিত করেন। পরবর্তীতে ৭৭৫ খ্রি: খালিদ বিন বার্মাককে খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
ইফ্রিকিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা
এই সময় ইফ্রিকিয়াতে বার্বার ও খারিজীগণ আব্বাসীয় খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে খলীফা আল-মনসুর ৭৭২ খ্রি: তাদের দমন করেন এবং ইফ্রিকিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ইয়াজিদ ইবনে মুহাল্লাব এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সফল হন ও ১৫ বছর শাসন করেন।
আলী বংশীয়দের বিরুদ্ধে অভিযান
যদিও আলী বংশীয়গণ আব্বাসীয় আন্দোলনে ব্যাপক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন কিন্তু তাদের প্রতি আব্বাসী খলীফাগণ সুবিচার করেননি। তারা ভবিষ্যতে খিলাফত দাবি করবে এই আশংকায় আল-মনসুর তাদেরকে নির্মূল করার নীতি গ্রহণ করেন । উমাইয়া খিলাফত পতনেরকালে মদীনায় সর্বসম্মতভাবে গৃহিত হয় যে, উমাইয়াদের পতনের পর ইমাম হাসানের প্রপৌত্র মুহাম্মদ খিলাফত গ্রহণ করবেন, সকলে তাকে তাঁর চারিত্রিক পবিত্রতার জন্য ‘নফস উস-যাকিয়া’ (পবিত্র আত্মা) উপাধিতে ভূষিত করেন। মদিনায় ইমাম হাসান ও হুসাইনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিক কারারুদ্ধ হন। এভাবে আল মনসুর তাঁর রাজত্বকালের কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত করেন।
রাজ্যবিস্তার
৭৭৩ খ্রি: আল মনসুর রোমানদের বিরুদ্ধে সালিহ ও আব্বাসের নেতৃত্বে ৭০ হাজারের একটি মুসলিম বাহিনী প্রেরণ করেন। যুদ্ধে রোমান সম্রাট ৪র্থ কনস্টানটাইন পরাজিত হন ও বার্ষিক কর প্রদান করতে সম্মত হন। মালাতিয়া দুর্গ পুনরায় আব্বাসীয়দের দখলভুক্ত হয়। সাম্রাজ্যের সুরক্ষার জন্য তিনি গ্রীক সীমান্তে কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেন। কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত তাবারিস্তানের অধিবাসীগণ ৭৫৯-৬০ খ্রি: তাদের যুবরাজ ইস্পাহান্দের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করলে, আল মনসুর অভিযান প্রেরণ করে তাদের দমন করেন। তাবারিস্তান ও গীলান তাঁর দখলে আসে। দায়লম অঞ্চলটিও আব্বাসীয়দের অধীনস্থ হয়। খালিদ বিন বার্মাককের নেতৃত্বে এশিয়া মাইনরের উপজাতীয়দের বিদ্রোহ দমন করেন। জর্জিয়া, মসুল, আর্মেনিয়া ও কুর্দিস্তান তাঁর সাম্রাজ্যের অর্ন্তভূক্ত হয়। তিনি স্পেনে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। যেখানে ৭৫৬ খ্রি: অপর একটি উমাইয়া স্বাধীন আল-আমিরাত প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু তাঁর এই অভিযানটি সফল হয়নি।
খলীফা মনসুর ২২ বছর রাজত্ব করার পর ৬৫ বছর বয়সে ৭৭৫ খ্রি: মৃত্যুবরণ করেন। মক্কায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে পথিমধ্যে বীরে মায়মুনা নামক স্থানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।
উত্তরাধিকারী মনোনয়ন
আবুল আব্বাস তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর ভাই আবু জাফর ও তাঁর পরে তাঁর ভাতিজা ঈসাকে পর পর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যান। কিন্তু খিলাফত লাভের পর আল মনসুর ঈসাকে খিলাফতের দাবি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেন এবং মৃত্যুর পূর্বে তদ্বীয়পুত্র মুহাম্মদকে ‘আল-মাহদী' উপাধি দিয়ে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।
বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা
বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠা (৭৬২-৬৬) করে খলীফা আল-মনসুর চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি তাঁর বংশের জন্য একটি নিরাপদ আবাসস্থল খুঁজতে থাকেন এবং পারস্য সম্রাট কিসরার গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল বাগদাদকে মনোনীত করেন। এটি দজলা নদীর পশ্চিম তীরে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ অবস্থিত। সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি অঞ্চল হতে আনীত ১,০০,০০০ শ্রমিক ও শিল্পী সুদীর্ঘ ৪ বছর (৭৬২-৬৬) অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রায় ৪৮,৮৩,০০০ দিরহাম ব্যয়ে এ নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন। এ নগরীর নামকরণ হয় ‘দারুস-সালম' (শান্তি নিবাস)। এটিকে খলীফার নামানুসারে ‘মনসুরীয়া’ও বলা হয়ে থাকে। এটি ছিল বৃত্তাকার ও ২ প্রাচীর বিশিষ্ট নগরী এর কেন্দ্র ছিল। রাজপ্রাসাদ, জামে মসজিদ, প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীদের অট্টালিকা, উদ্যান ও কৃত্রিম ফোয়ারা। আরব্য রজনীর বাগদাদ ছিল তৎকালীন বিশ্বের বিস্ময় ও জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্র।
নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠন
আল-মনসুর বহিঃশক্তির আক্রমণ হতে নিরাপদ থাকা ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের জন্য একটি সুদক্ষ নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠন করেন । তিনি সৈনিকদের উচ্চ পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করেন।
গুপ্তচর বাহিনী নিয়োগ
তিনি অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য গুপ্তচর বাহিনী গঠন করেন। যা সাম্রাজ্যের সর্বত্র হতে খলীফাকে সংবাদ প্রেরণ করতো।
প্রদেশের সীমানা পুনঃনির্ধারন
বিশাল সাম্রাজ্যকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও রক্ষনাবেক্ষণের জন্য তিনি প্রদেশের সীমানা নির্ধারণ করেন। সৎ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে তিনি প্রদেশপাল নিয়োগ করতেন। সুষ্ঠুভাবে শাসন কার্য পরিচালনার জন্য তিনি প্রশাসনিক কর্মচারীদের রদবদল করতেন।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য খলীফা আল-মনসুর সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শহরে কাজী নিয়োগ করেছিলেন। বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে কাজীগণ নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ছিলেন। মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমানকে বাগদাদের প্রধান কাজী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং তিনি উক্ত পদে প্রায় ২০ বছর বহাল ছিলেন। খলীফা বিচারকার্যের প্রতি আনুগত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখে গেছেন। একদা তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় উস্ট্রের মালিকের অভিযোগ আরোপিত হলে তিনি কাজীর রায় মেনে নেন এবং কাজীকে তাঁর সততা ও নিরপেক্ষতার জন্য পুরষ্কৃত করেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক
খলীফা আল-মনসুর শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আব্বাসীয় খিলাফতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ভিত্তি তিনিই প্রথম রচনা করেন। তিনি তাঁর রাজ্য জুড়ে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব ও শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন । তিনি নিজেও একজন শিক্ষানুরাগী ও পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন।
জনকল্যাণমূলক কার্যাবলি
খলীফা আল-মনসুর তাঁর জনগণের কল্যাণ ও সুন্দর জীবন যাপনের জন্য বহু রাজপথ, সরাইখানা, নগর ও চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি সাম্রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি অর্থনীতির প্রতি মনোযোগী হন। তিনি শিক্ষাকেন্দ্র ও গবেষণাগার স্থাপন করেন।
পাঠ-৮.৪
আবু জাফর আল-মানসুর এর চরিত্র ও কৃতিত্ব
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
আল মনসুরের চরিত্র বর্ণনা করতে পারবেন।
খলীফা আল-মনসুরের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
প্রাক-ইসলামী যুগ, ভারতীয় ‘সিদ্ধান্ত’, বাবুল জাহাব, কাসরুল খুলদ, রুসাফা রাজপ্রাসাদ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন, হানাফী ও মালেকী মাজহাব
চারিত্রিক সংমিশ্রণ
খলীফা আবু জাফর আল-মনসুর দীর্ঘকায়, শ্যামবর্ণ ও ক্ষীণদেহের অধিকারী ছিলেন। তার চরিত্রে দোষ-গুণের বিচিত্র সমাবেশ লক্ষ করা যায়। একদিকে তিনি ছিলেন কোমল, প্রজারঞ্জক, ন্যায়পরায়ণ, আদর্শবাদী ও দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব। অপরদিকে তিনি ছিলেন শত্রুর প্রতি অত্যাচারী, কপট, বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ ও স্বৈরাচারি শাসক। তিনি সানবাদের বিদ্রোহ, হিরাতের বিদ্রোহ ও বার্বার খারিজীদের বিদ্রোহ অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে দমন করেছিলেন। অপরদিকে ইমাম হাসানের বংশধর মুহাম্মদ ও ইব্রাহিমের প্রতি তাঁর আচরণ ছিল নিষ্ঠুর ও বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ। তিনি তাঁর পিতৃব্য আব্দুল্লাহ, ভ্রাতুষ্পুত্র ঈসাকে তাদের দাবি হতে অপসৃত করেন। আবু মুসলিম খোরাসানীর মত যোগ্য ও মেধাবী ব্যক্তিত্বকে তিনি নিজ বংশের স্বার্থরক্ষার জন্য হত্যা করেছিলেন। আব্বাসীয় শাসন ব্যবস্থা দৃঢ় করার জন্য তিনি এই কঠোরতা অবলম্বন করেন।
আদর্শবান
ব্যক্তিগত জীবনে আবু জাফর আল-মনসুর ছিলেন আদর্শবান ব্যক্তি। কোন প্রকার চারিত্রিক দুর্বলতা তাঁর ছিল না। অপবিত্রতা ও অশালীনতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ন্যায়-নিষ্ঠ, মিতব্যয়ী, ধৈর্যশীল ও কঠোর পরিশ্রমী হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর পুত্র মুহাম্মদ আল-মাহদীকে যে অছিয়ত দান করেন তা তাঁর অভিজ্ঞতা দৃঢ় চরিত্র ও উন্নত শাসনদক্ষতার পরিচয় বহন করে।
আল-মনসুরের কৃতিত্ব : রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি
খলীফা আল-মনসুর একজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর দূরদৃষ্টির মাধ্যমে বুঝতে সক্ষম হন যে, আব্বাসীয় খিলাফত একসময় বিলুপ্ত হবে, তাই জনগণের সমর্থন ও আস্থা অর্জনের মধ্যে দিয়ে এর স্থায়িত্বকে ধরে রাখা সম্ভবপর হবে। তাই তিনি পার্থিব ক্ষমতার সাথে আধ্যাত্মিকতার এক সংমিশ্রণ ঘটান। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সুন্নী মতবাদের ভিত্তি গড়ে ওঠে। হানাফী ও মালেকী মাযহাব গড়ে ওঠেছিল। এর ফলে শিয়াদের আধিপত্য অনেকটা হ্রাস পায় ও খলীফা ধর্মীয়ভাবে অনেকটা স্বীকৃতি পান।
প্রশাসনিক সংস্কার
আব্বাসীয় খিলাফতের উযীর ও জল্লাদের পদটি আবু জাফর আল-মনসুরের সময় অব্যাহত থাকে। উযীর খলীফাকে শাসনকার্যে নানাভাবে সাহায্য করেন। খালিদ বিন বার্মাকী তাঁর প্রধান উযীর ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে খলীফা আল মানসুর আব্বাসীয় প্রশাসনকে একটি মজবুত কাঠামো দান করেছিলেন।
আব্বাসী বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা
আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ মাত্র ৩ বছর রাজত্ব করেন, তাই তিনি আব্বাসীয়দের শাসন কাঠামো তৈরী করে যেতে পারেননি। তিনি কেবল আব্বাসীয়দের চিরশত্রু উমাইয়াদের প্রতি ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ কার্যকরণ করেছিলেন। কিন্তু খলীফা আল-মানসুর সিংহাসনে আরোহন করে অভ্যন্তরীন বিদ্রোহসমূহ দমন করেন, আব্বাসীয় খিলাফতের সম্ভাব্য হুমকি ও
সমস্যাগুলোকে প্রতিহত করেন এবং ভবিষ্যৎ বংশধরের জন্য সিংহাসন নিষ্কন্টক করেন। বাগদাদ নগরীর মত সুরক্ষিত একটি রাজধানী স্থাপন করেন। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও তিনি সমান সফলতা অর্জন করেন। তাই তিনিই ছিলেন আব্বাসীয় বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা । Syed Ameer Ali এই প্রসংগে বলেন-Although Saffah is the first sovereign of the Banu Abbas, Abu Jafor must be regarded as the real founder of the dynasty.
বিজেতা হিসেবে
বিজেতা হিসেবেও খলীফা আল-মনসুর অগ্রগণ্য ছিলেন। তিনি ৭৭৩ খ্রিঃ রোমান সম্রাট ৪র্থ কনস্টানটাইনকে পরাজিত করে মালাসিয়া দুর্গটি দখল করেন। গ্রীক সীমান্তে নিরাপত্তার জন্য দুর্গ নির্মাণ করেন। তারাকিস্তান, আর্মেনিয়া, কুর্দিস্তান তাঁর সময়ে আব্বাসীয়দের হস্তগত হয়।
অভ্যন্তরীন বিদ্রোহ দমন
ক্ষমতায় আরোহণ করেই খলীফা আল-মনসুর অভ্যন্তরীন বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সানবাদের বিদ্রোহ, আফ্রিকার বার্বার ও খারিজী বিদ্রোহ, খুরাসান ও তাবারিস্তানের বিদ্রোহ এবং রাওয়ান্দিয়া সম্প্রদায়ের বিদ্রোহকে দমন করে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
বিদ্যানুরাগী নরপতি
খলীফা আল-মনসুর একজন বিদ্যানুরাগী নরপতি ছিলেন। আব্বাসীয়দের দ্বারা শিক্ষা-সংস্কৃতির যে উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিলো তাঁর বীজ আবু জাফর আল-মনসুর কর্তৃক রোপিত হয়েছিল। আব্বাসীয়দের যুগ ছিল তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ যার সূত্রপাত হয় আল-মনসুরের সময়কাল হতে। খলীফা বহু স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা নির্মাণ ও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি নিজেও বিজ্ঞান ও গণিত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর সময়ে কুরআনের তাফসীর (ব্যাখ্যা) এবং হাদীস সংকলিত ও সংগৃহীত হয়। তিনি প্রাক-ইসলামী যুগের আরবী কবিতা সমূহও লিপিবদ্ধ করেন।
অনুবাদ বিভাগ স্থাপন
খলীফার রাজদরবারে অনেক পণ্ডিত ও জ্ঞানী-গুণী সমাদর পেতেন। খলীফা তাদের সমন্বয়ে একটি অনুবাদ বিভাগ স্থাপন করেন। এই বিভাগ গ্রীক, পারসিক, সংস্কৃত প্রভৃতি নানান ভাষায় লিখিত বহু মূল্যবান পুস্তকাদি আরবী ভাষায় অনুবাদ করে। তাঁর তত্ত্বাবধানে এরিস্টটল, ইউক্লিড ও টলেমীর গ্রন্থসমূহ, ভারতীয় ‘সিদ্ধান্ত' খণ্ডকা-খাদ্যকা, হিতোপদেশ আরবী ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
স্থাপত্য শিল্পের উৎকর্ষ
স্থাপত্য শিল্পে আবু জাফর আল-মনসুরের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত টাইগ্রীস নদীর তীরে অবস্থিত বৃত্তাকার বাগদাদ নগরী জগৎ বিখ্যাত। তিনি রাফিকা নামক অপর একটি শহরও নির্মাণ করেন। কুফা ও বসরা নগরীর প্রাচীর, বাব আল-যাহাব (স্বর্ণদ্বার), কাসরুল খুলদ (অনন্তধারা) ও রুসাফা রাজপ্রাসাদ তাঁর স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন।
সারসংক্ষেপ:
আবু জাফর আল-মানসুর ছিলেন বিপরীত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে গঠিত একজন মানুষ। তাঁর চরিত্রে কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছিল। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও কঠোর সাধনার ফলেই আব্বাসীয় খিলাফত গৌরবের যুগে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি ন্যায়বিচারক, প্রজাহিতৈষী, শ্রেষ্ঠ বিজেতা, বিদ্যানুরাগী ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই নৃপতির মাধ্যমেই আব্বাসীয়রা গৌরবের সাথে ৫০৮ বছর শাসন করতে সক্ষম হয়েছিল। কারণ তিনিই ছিলেন এই বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।
পাঠ-৮.৫
আল-মাহদী ও আল-হাদী
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
আল-মাহদীর পরিচয় ও রাজত্বকাল সম্পর্কে জানতে পারবেন।
আল-হাদীর পরিচয় ও তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন
মুখ্য শব্দ
প্রজাবৎসল, জিন্দিক সম্প্রদায়, মুবাইয়া (শ্বেতবসন পরিহিত), আল-হাদী, মুকান্না,
মুহাম্মির ও ইদ্রিসীয় বংশ
আল-মাহদী-(৭৭৫-৭৮৫) খ্রি:
খলীফা আবু জাফর আল-মানসুরের পুত্র ছিলেন মুহাম্মদ। তিনি ৭৭৫ খ্রি: আল-মাহদী উপাধি নিয়ে বাগদাদের আব্বাসীয় সিংহাসনে আরোহণ করেন।
শাসননীতি
শাসনপ্রণালীর ক্ষেত্রে আল-মাহদী ছিলেন তাঁর পিতার বিপরীত। তিনি শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। অযথা রক্তপাত ও কঠোরতা পরিহার করে তিনি উদার ও সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি প্রজাবৎসল ও দয়ালু ছিলেন। তিনি অন্যায়ভাবে অবরুদ্ধ ব্যক্তিদের মুক্তি দেন এবং হজ্ব পালনের জন্য ৭৭৬-৭৭ খ্রি: মক্কা ও মদীনাবাসীর মাঝে ৩ কোটি দিরহাম দান করেন ।
বিদ্রোহ দমন :
ক) খোরসানে বিদ্রোহ : আল-মাহদীর সময়ে খোরাসানে এ বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়। এর নেতৃত্ব দেন ইউসুফ ও তাঁর প্রধানমন্ত্রী ইয়াকুব ইবনে দাউদ। আল-মাহদী তাদের বন্দী করে কারাগারে পাঠান। ফলে খোরাসানের বিদ্রোহ দমন সম্ভবপর হয়েছিল।
খ) মুকান্নার আবির্ভাব : তাঁর রাজত্বকালে মুকান্না নামে এক ভণ্ডনবীর আবির্ভাব ঘটে। সে সর্বদা মুখোশ পরিধান করতো। তাই তাকে বলা হতো মুকান্না। সে নিজেকে নবী হিসেবে দাবি করেন। তার অনুচরবর্গ সাদা পোষাক পরিধান করতো। তাই তাদেরকে মুবাইয়া (শ্বেতবসন পরিহিত) বলা হতো। খলীফা মুকান্নার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
গ) যিন্দিক সম্প্রদায় : এই সময় কাস্পিয়ান সাগরের পূর্বদিকে জুরজান নামক স্থানে মুহাম্মির বা লাল পোশাক পরিহিত ধর্মদ্রোহী জিন্দিক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। খলীফা এ সম্প্রদায়কে কঠোর হস্তে প্রতিহত করেন।
গ্রীকদের বিরুদ্ধে অভিযান
৭৭৮ খ্রি: গ্রীক সৈন্যরা আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের সীমান্তে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে এবং সেখানে ব্যাপক লুটতরাজ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে । খলীফা তাঁর পুত্র হারুনকে সৈন্যসহ সেখানে এক অভিযান প্রেরণ করেন। গ্রীক সৈন্যরা পরাজিত হয় এবং সম্রাজ্ঞী আইরিন বার্ষিক কর দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন।
উত্তরাধিকারী মনোনয়ন ও মৃত্যু
আল-মাহদী ১০ বছর শাসন করেন। এই সময় আব্বাসীয় সাম্রাজ্য সুসংহত ও সমৃদ্ধি অর্জন করে। আল-মাহদী ৭৮৫ খ্রি: মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর দুই পুত্র মুসা ও হারুনকে পর পর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান ।
আল-হাদী- (৭৮৫-৮০৯) খ্রি:
ক্ষমতায় আরোহণ : পিতা আল-মাহদীর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ্য পুত্র মুসা ‘আল-হাদী' (পথ প্রদর্শক) উপাধি নিয়ে ৭৮৫ খ্রি: বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি তাঁর পিতার মনোনয়নকে অস্বীকার করেন এবং পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর ভ্রাতা হারুনের পরিবর্তে নিজ পুত্র জাফরকে মনোনীত করেন। এই সময় হারুনের কতিপয় সমর্থক ও প্রধান উপদেষ্টা খালিদ বিন বার্মাককে তাঁর অনুচরসহ বন্দী করেন। রাজপ্রাসাদ অনিরাপদ হয়ে পড়লে হারুন রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেন ও অন্যত্র আশ্রয় নেন। আল-হাদীর স্বল্পকালীন রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ইরাক ও খোরাসানে খারিজী বিদ্রোহ ও যিন্দিকীয় বিদ্রোহ। তিনি এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন। তাঁর শাসনামলের অপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে মরক্কোতে ইদ্রিসীয় বংশ প্রতিষ্ঠা।
চরিত্র : ৭৮৬ খ্রি: বাগদাদের নিকটবর্তী ঈসাবাদ নামক জায়গায় নৌবিহারকালে আল-হাদী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি তাঁর মাতার কাছে তাঁর অন্যায়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং পিতার ইচ্ছানুসারে তাঁর ভ্রাতা হারুনকে পরবর্তী খলীফা হিসেবে মনোনীত করেন।
সারসংক্ষেপ:
খলীফা আল-মাহদী ও আল হাদী অতি অল্প সময় আব্বাসীয় খিলাফত পরিচালনা করেন। তাঁরা মূলত আবু জাফর আল- মানসুরের শাসনকাঠামো অনুসরণ করেছেন। তাঁদের রাজত্বকাল আব্বাসীয় খিলাফতের একটি অনুজ্জল অধ্যায় হলেও তাদের পরবর্তী খলীফা হারুন এর রাজত্বকাল ছিল গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে মরক্কোতে ইদ্রিসীয় বংশ প্রতিষ্ঠা, ভণ্ডনবী মুকান্নার আবির্ভাব, যিন্দিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও গ্রীক-আব্বাসীয় পারস্পরিক সম্পর্ক।
হারুন-অর-রশিদের খিলাফত লাভ এবং তাঁর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
খলীফা হারুন-অর-রশিদ এর পরিচয় ও খিলাফত লাভের বর্ণনা দিতে পারবেন।
খলীফা হারুন-অর-রশিদের অভ্যন্তরীণ নীতি ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
খলীফা হারুন-অর-রশিদের বৈদেশিক নীতি আলোচনা করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
নরপতি, বাগদাদ নগরীর স্রষ্টা ও ‘আরব জোয়ান-অব-আর্ক
পরিচয়
বিশ্বের ইতিহাসে যে সকল নরপতি গৌরবের ইতিহাস রচনা করেছেন, যারা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় বাগদাদের আব্বাসীয় খলীফা হারুন-অর-রশিদ তাদের মধ্যে একজন। তিনি ছিলেন রূপকথার বাগদাদ নগরীর স্রষ্টা। তাঁর খিলাফত আব্বাসীয় বংশকে এমনই এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল যা আর কোন শাসকের পক্ষে তেমনটি সম্ভব হয়নি। ৩৭ জন আব্বাসীয় খলীফার মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা সফল রাজনীতিবিদ, সমরনায়ক, শ্রেষ্ঠ শাসক, প্রজারঞ্জক, বিদ্যানুরাগী ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক। তিনি ছিলেন খলীফা আল-মাহদীর কনিষ্ঠ পুত্র এবং আল-হাদীর ভ্রাতা ।
খিলাফত লাভ ও প্রাথমিক কার্যাবলি
ভ্রাতা আল-হাদীর মৃত্যুর পর ৭৮৬ খ্রিঃ ২৫ বছর বয়সে হারুন-অর-রশীদ বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে বসেই তিনি তাঁর মাতা খায়জুরানকে সকল প্রকার সুবিধা প্রদান করেন। খলীফা তাঁর বাল্য শিক্ষক বিখ্যাত ইয়াহিয়া বিন-খালিদ বার্মাকীকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। তাঁর পুত্রদ্বয় ফজল ও জাফরকে উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত করেন ।
অভ্যন্তরীণ নীতি
বাগদাদ নগরী
খারিজী বিদ্রোহ দমন : তার খিলাফতের শুরুতেই খারিজীরা বিদ্রোহ শুরু করে। ৭৮৭-৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মসুলে প্রথম খারিজী উপদ্রব দেখা দেয়। বিদ্রোহীরা মেসোপটেমিয়ার রাজধানী দখল করলে খলীফা তাঁর সেনাবাহিনীর সহায়তায় বিদ্রোহ দমন করেন। ওয়ালিদ বিন তারিকের নেতৃত্বে অপর একটি বিদ্রোহ নাসিবিনে শুরু হয়। খারিজীগণ আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান আক্রমণ করেন এবং হলওয়ান পর্যন্ত তাদের প্রভাব বিস্তার করে। এক যুদ্ধে তাদের নেতা ওয়ালিদ নিহত হলে তাঁর ভগ্নী লায়লা খারিজীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। খলীফার বাহিনী তাঁর নিকট পরাজিত হয়। অবশেষে জনৈক সেনাপতি তাকে অস্ত্র ত্যাগ করে পারিবারিক জীবনে ফিরে যেতে অনুরোধ করলে তিনি বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটান। তিনি আরবীয় ইতিহাসে ‘আরব জোয়ান-অব-আর্ক' (Arab Joan-of- Arc) নামে পরিচিত। তিনি রূপসী ও সুপ্রসিদ্ধ কবি ছিলেন।
মধ্য-এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা : খলীফা হারুন-অর-রশিদের সময় মধ্য এশিয়ায় সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালিত হয়েছিল। ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে কাবুল ও কান্দাহার আব্বাসীদের অধীনস্ত হয় এবং সাম্রাজ্যের সীমানা হিন্দুকুস পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। খলীফা দক্ষ সামরিক কর্মকর্তা এই অঞ্চলে নিয়োগ করেন ।
আর্মেনিয়ার খাজার বিদ্রোহ দমন : ৭৯৯ খ্রি: খাজার উপজাতি আর্মেনিয়ায় বিদ্রোহ সৃষ্টি করে। খলীফা তাদেরকে দমন করার জন্য দুজন শ্রেষ্ঠ সেনাপতিকে প্রেরণ করেন। তারা এই অভিযানে সফলতা অর্জন করেন।
মুদারীয় ও হিমারীয়দের দমন : এই সময় সিরিয়া অঞ্চলে হিমারীয় ও মুদারীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ানক গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। একই সাথে সিন্ধু প্রদেশেও অনুরূপ গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। খলীফা এই গৃহযুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাপতি মুসাকে সিরিয়ায় ও সেনাপতি দাউদ মুহাল্লাবীকে সিন্ধু প্রদেশে প্রেরণ করেন।
আলী (রা.) এর বংশধরদের প্রতি আচরণ : আব্বাসীয় খলীফাগণ সর্বদাই আলী (রা.) এর বংশধরদের তাদের নিজ বংশের জন্য হুমকিস্বরূপ মনে করতেন। খলীফা আল-মানসুর ইমাম হাসান (রা.) এর বংশধর মুহাম্মদ ও ইব্রাহিমকে হত্যা করার পর তাদের ছোট ভাই ইয়াহিয়া দাইলামে আত্মগোপন করেন। খলীফা হারুনের খিলাফতকালে ইয়াহিয়া বিদ্ৰোহ ঘোষণা করেন। ফজল বার্মাকী সুকৌশলে এই বিদ্রোহ দমন করেন। খলীফা আলী বংশীয় শ্রেষ্ঠ জ্ঞান সাধক মুসা আল- কাযিমকেও কারাগারে বন্দী করেন। ৭৯৯ খ্রি: বন্দী অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আলী আল- রিজা পরবর্তী ইমাম নিযুক্ত হন।
আফ্রিকায় আঘলাবী শাসন প্রতিষ্ঠা : খলীফা আল-হাদীর সময়ে উত্তর আফ্রিকার মরক্কোতে ইদ্রিসীয় বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকেই উত্তর আফ্রিকা আব্বাসীয় শাসন হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আব্বাসীয় খলীফাগণ বহুচেষ্টা করেও তা পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। খলীফা হারুন-অর-রশিদ ৭৮৭ খ্রি: তাঁর সেনাপতি হারসামাকে উত্তর আফ্রিকার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। হারসামা প্রায় ৩ বছর যোগ্যতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
এই প্রদেশের ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থার কথা চিন্তা করে খলীফা হারসামার পরামর্শে বাৎসরিক ৪০,০০০ দিনার কর প্রদানের শর্তে ইব্রাহিম ইবনে আগলাবের উপর ইফ্রিকিয়া অঞ্চলের শাসনভার ছেড়ে দেন। তখন থেকে বংশানুক্রমিকভাবে বাগদাদের খলীফার অনুমোদনক্রমে আফ্রিকায় আঘলাবীয় বংশের শাসন শুরু হয় যা ১০৯ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করে।
উত্তরাধিকারী মনোনয়ন : খলীফা হারুন সম্রাজ্ঞী জুবাইদা ও তাঁর ভ্রাতা ঈসার চাপে তাঁর পুত্র মুহাম্মদকে (আল-আল- আমিন) প্রথম উত্তরাধিকারী, আব্দুল্লাহ (আল-মামুন) কে দ্বিতীয় উত্তরাধিকারী ও কনিষ্ঠ পুত্র কাসিম (মুতাসিন) কে পরপর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।
বৈদেশিক নীতি
বাইজান্টাইনদের সাথে যুদ্ধ : হারুন-অর-রশীদ ও বাইজান্টাইন শক্তির মধ্যকার বিরোধ ছিল তাঁর সময়ে সর্বাপেক্ষা আলোচিত ঘটনা। খলীফা আল-মাহদীর সময় সম্রাজ্ঞী আইরিন যে চুক্তি করেছিলো তা ভঙ্গ হয়। ৭৯১ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় অধীনস্ত রাজ্য আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে। মুসলিম সেনাবাহিনী বাইজানটাইনদের কাছ হতে মাতাবা ও আনসিরা শহর দুটি এবং ভূমধ্যসাগরীয় সাইপ্রাস ও ক্রীট দ্বীপ দুটিও দখল করে নেয়। ৮০২ খ্রিঃ সম্রাজ্ঞী আইরিন সিংহাসনচ্যুত হন এবং কোষাধ্যক্ষ নাইসিফোরাস ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। নাইসিফোরাস খলীফার নিকট অপমানসূচক পত্র প্রেরণ করেন এবং সম্রাজ্ঞী আইরিন প্রদত্ত করের দ্বিগুণ অর্থ দাবি করেন ।
ক্ষুদ্ধ খলীফা তাঁর সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং নাইসিফোরাসকে পরাজিত ও কর প্রদানে বাধ্য করেন। চুক্তি ভঙ্গকারী নাইসিফোরাস পরপর ৩ বার খলীফার সাথে চুক্তিভঙ্গ করেন এবং প্রতিবারই খলীফা তাঁর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে তাকে পরাজিত ও কর প্রদানে বাধ্য করেন। এতে একদিকে খলীফা হারুন-অর-রশীদের উদারতা ও অপরদিকে তাঁর অদূরদর্শিতা প্রকাশ পেয়েছে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক : হারুন-অর-রশীদের সুনাম সুখ্যাতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ছড়িয়ে পড়েছিল । তিনি চীনা সম্রাট ফাগফুরকে দূত প্রেরণ করে তাঁর সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। ভারতবর্ষেও তিনি উপহার ও দূত প্রেরণ করেন। ফ্রান্সের রাজা শার্লিমেনের সাথে তাঁর কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। খলীফা শার্লিমেনকে অত্যন্ত দামী কারুকার্যময় একটি জলঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন।
পাঠ-৮.৭
হারুন-অর-রশীদের চরিত্র ও কৃতিত্ব
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
হারুন-অর-রশীদের চারিত্রিক দিকগুলো বিশ্লেষণ করতে পারবেন। হারুন-অর-রশীদের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
বার্মাকী পরিবার, স্বর্ণযুগের দ্রষ্টা, পাশ্চাত্যের শার্লিমেন, নহর-ই-জুবায়দা, ‘প্রাচ্যের রাণী’, হানাফী মাজহাব ও ‘আরব্য রজনীর উপন্যাস
হারুন-অর-রশীদের রাজত্বকাল ছিল ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ।
চারিত্রক বৈশিষ্ট্য
কঠোর ও কোমলতার সহাবস্থান
আব্বাসীয় খলীফা হারুন-অর-রশীদের চরিত্র ছিল কঠোরতা ও কোমলতার সংমিশ্রণে তৈরি। অন্যায় ও বিদ্রোহীদের প্রতি তিনি ছিলেন কঠোর, অপরদিকে অসহায় ও সম্বলহীনদের জন্য তাঁর হৃদয় ছিল কোমল। তিনি ছিলেন তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ, উদার, মহানুভব, দানবীর ও বিচক্ষণ নরপতি । ধর্মপরায়ণ খলীফা হারুন-অর-রশীদ ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরও তিনি প্রত্যহ রাত্রিকালে একশত রাকাত নফল সালাত আদায় করতেন। তিনি তাঁর ২৩ বছর শাসনকালে নয় বার হজ্ব পালন করেন এবং প্রতিবার একশত জন আলিমকে তাঁর সাথে হজ্ব করার জন্য নিয়ে যেতেন। তিনি প্রতিদিন ১০০০ দিরহাম দান করতেন । সন্দেহপরায়ণতা ও ধৈর্যহীনতা তার পূর্ববর্তী শাসকদের মত তিনিও সন্দেহপরায়ণ ছিলেন। তাঁর ফলে তিনি আলী (রা.) এর বংশধরদের ও বার্মেকী পরিবারের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেন যা তাঁর ব্যক্তিত্বে স্বৈরাচারী শাসকের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করেছে।
কৃতিত্বসমূহ
স্বর্ণযুগের দ্রষ্টা ও স্রষ্টা
খলীফা হারুন-অর-রশীদ ছিলেন আব্বাসী খলীফাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নৃপতিদের মধ্যে অন্যতম। ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন যে, “নবম শতাব্দীর প্রারম্ভে জাগতিক কার্যকলাপ নিয়ামক দুটি বিশাল ব্যক্তিত্বশালী নৃপতির নাম দেখা যায়- পাশ্চাত্যে শার্লিমেন, আর প্রাচ্যে হারুন-অর-রশীদ, এর দুজনের মধ্যে নিঃসন্দেহে হারুন অধিকতর শক্তিশালী এবং উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী ছিলেন।”
ন্যায় বিচারক ও প্রজারঞ্জক
খলীফা হারুন-অর-রশীদ ন্যায়বিচারক ও প্রজারঞ্জক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি প্রজাদের অবস্থা দেখার জন্য প্রত্যেক রাত্রিতে ছদ্মবেশে নগর ভ্রমণ করতেন। তিনি সীমান্ত অঞ্চল ও দুর্গ পরিদর্শন করতেন। তিনি তাঁর কর্মে যত্নশীল ছিলেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি প্রজাদের মঙ্গল সাধন করতেন।
জনকল্যাণমূলক কাজ
খলীফা হারুন-অর-রশীদ হজ্বযাত্রী ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য বহু স্কুল,
মাদ্রাসা, মসজিদ, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র ও সরাইখানা নির্মাণ করেন। তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটান।
তাঁর স্ত্রী সম্রাজ্ঞী যুবায়দা মক্কায় হাজীদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য নহর-ই-জুবায়দা নামে একটি খাল খনন করেন। খলীফা গরীব ও অসহায় ব্যক্তির জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেন।
সমর কুশলী
খলীফা হারুন-অর-রশীদ ছিলেন আব্বাসীয় বংশের একজন শ্রেষ্ঠ সমরবিদ। তাঁর একটি বিশাল ও সুশিক্ষিত সামরিক
বাহিনী ছিল, যার তত্ত্বাবধান খলীফা নিজেই করতেন। বিদ্রোহ দমন ও বৈদেশিক শত্রুকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাঁর সামরিক দক্ষতা তিনি প্রমাণ করেন ।
শাসন কাঠামো
দীর্ঘ তেইশ বৎসর রাজত্বকালে খলীফা আব্বাসীয় খিলাফতের জন্য একটি পরিপূরক শাসন কাঠামো সৃষ্টি করেন। বিখ্যাত বার্মাকী উযির পরিবার ছিল খলীফার শাসন কাঠামোর জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।
বাগদাদের ঐশ্বর্য
খলীফা হারুন-অর-রশীদের রাজত্বকালে বাগদাদ নগরী তৎকালীন বিশ্বে শ্রেষ্ঠ নগরীর মর্যাদা লাভ করে। বাগদাদকে এই সময় অভিহিত করা হত ‘প্রাচ্যের রাণী' বলে। ধন-প্রাচুর্যে, শিল্প-সাহিত্যে, অর্থনীতি-বাণিজ্যে, স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণ সকল দিক থেকে বাগদাদ নগরী ছিল অদ্বিতীয়। বাগদাদের বাজার ছিল দেশ-বিদেশের পণ্যে পরিপূর্ণ। বাগদাদের পণ্য ছিল জগৎবিখ্যাত। নৌবন্দর হিসেবে বাগদাদের সুদীর্ঘ পোতাশ্রয় জুড়ে শত শত বাণিজ্য জাহাজ শোভা পেত। বাগদাদের সৌন্দর্য ও আভিজাত্য প্রসংগে P. K. Hitti বলেন, It was then that Baghdad became a city with no peer throughout the whole world'.
জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক
খলীফা হারুন-অর-রশীদের রাজত্বকালে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা প্রকৃত অর্থে বিস্তর লাভ করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ এই সময়ে আব্বাসীয়রা অর্জন করতে সক্ষম হয়। বাগদাদ নগরী ছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তের জ্ঞানী-গুণীর কর্মস্থল। খলীফা তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন। রাজদরবার ছিল তাদের পদচারনায় মুখরিত। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সংগীত, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এই সময়ে শুরু হয়।
খলীফার প্রচেষ্টায় তাঁর পূর্বসূরী খলীফা আল-মনসুরের অনুবাদ বিভাগ সম্প্রসারিত ও বিকশিত হয়। এই সময় হানাফী মাজহাব আত্মপ্রকাশ করে খলীফার প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফের তত্ত্বাবধানে। ইমাম আল বুখারী (রহ.) হাদীসশাস্ত্র প্রণয়ন করেন। আবু নুয়াস খলীফার রাজদরবারের একজন স্বনামধন্য কবি ছিলেন। আতিয়া ও আসমায়ী যথাক্রমে কবি ও ব্যাকরণবিদ ছিলেন। খলীফার তত্ত্বাবধানে গ্রীক দর্শনের আরবী অনুবাদ কর্ম সম্পন্ন হয়। খলীফা ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানী ‘মানকাকে' বাগদাদে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন। এছাড়াও সংগীত ও নৃত্যকলাও খলীফার প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। তাঁর সময়ের অন্যতম আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে আলিফলায়লা ওয়ালা ‘আরব্য রজনীর উপন্যাস' রচনা।
হানাফী মাযহাবের পৃষ্ঠপোষকতা
খলীফা হারুন-অর-রশীদ হানাফী মাযহাবকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। খলীফার প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফ ফিক্হ শাস্ত্রীয় আইন লিপিবদ্ধ করে সুনামের অধিকারী হন।
কূটনৈতিক সম্পর্ক
খলীফা হারুন-অর-রশীদ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বিখ্যাত একজন নৃপতি ছিলেন। পাশ্চাত্যের অনেক বরেণ্য নরপতির সাথে তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। চীন সম্রাট ফাগফুর ও ফরাসি সম্রাট শার্লিমেনের সাথে খলীফা দূত বিনিময় ও উপহার প্রেরণ করেন।
খলীফা আল-আমীন ও খলীফা আল-মামুনের মধ্যকার গৃহযুদ্ধের কারণ, ঘটনা ও ফলাফল
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
খলীফা আল-আমিন ও আল-মামুনের মধ্যকার গৃহযুদ্ধের কারণ সম্পর্কে জানতে পারবেন।
গৃহযুদ্ধের ঘটনাবলি সম্পর্কে বিবরণ দিতে পারবেন। গৃহযুদ্ধের ফলাফলসমূহ সম্পর্কে জানতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
চঞ্চল-বিলাসী, ভগিনীর পুত্র, আমোদপ্রিয়, উচ্চাভিলাষী ও মনোনয়নপত্র
৮০৯ খ্রি: খলীফা হারুন-অর-রশিদের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র আল-আল-আমিন খলীফার প্রাসাদে গমন করেন। পরের দিন তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং সকল আমীর, উমরাহ, সেনাপতি ও জনসাধারণের কাছ হতে আনুগত্যের শপথ লাভ করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা আল-মামুন ও আরেক ভাই কাসিম তাদের কর্মস্থল মার্ভ ও কিন্নীসিরিন হতে তাদের আনুগত্য ও উপহার প্রেরণ করেন।
আল-আমিন ও আল-মামুনের চরিত্রগত পার্থক্য
আল-আমিন ছিলেন খাঁটি আরব বংশদ্ভূত মাতা যুবাইদার পুত্র। অপরদিকে আল-মামুন ছিলেন একজন পারসিক ক্রীতদাসীর সন্তান। আল-আমিন তাঁর মাতা যুবাইদার ও মাতুল ঈসার তত্ত্বাবধানে ছিলেন এবং অপরদিকে আল-মামুন ছিলেন মাতৃহীন। তিনি উযির জাফর বার্মাকীর তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে উভয়েই ছিলেন ভিন্নধর্মী চরিত্রের অধিকারী। আল-আমিন ছিলেন অস্থিরমতি, চঞ্চল-বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত ও আমোদপ্রিয়। কিন্তু আল মামুন ছিলেন প্রজ্ঞাবান-বিচক্ষণ, দার্শনিক ও আইনজ্ঞ। তিনি পবিত্র কুরআন কণ্ঠস্থ করেন। এই চরিত্রগত পার্থক্য খলীফা হারুন-অর- রশীদ ও প্রজাদের নিকট তাঁকে অধিক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির আসনে বসিয়েছিলেন।
আল-আমিন ও মামুনের মধ্যে গৃহযুদ্ধের কারণ
পিতার ইচ্ছানুযায়ী আল-আমিন বাগদাদের সিংহাসনে বসেন এবং আল-মামুন তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যকার সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায় এবং গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়।
উত্তরাধিকার নীতির অনুপস্থিতি
খলীফা হারুন-অর-রশীদের একাধিক পুত্র ছিল। তারা সকলেই ছিলেন সিংহাসনের দাবিদার। কিন্তু খলীফা তাঁর প্রিয়তমা পত্নী জুবাইদা ও তাঁর ভ্রাতার চাপে পড়ে তাঁর জৈষ্ঠ্য পুত্র আল-আমিনকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু খলীফা হিসেবে আল-আমিন ছিলেন অযোগ্য যা এই গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ ।
আল-আমিন কর্তৃক মামুনের সেনাবাহিনী ও ধনাগার আত্মসাৎ
মৃত্যুশয্যায় খলীফা হারুন-অর-রশীদ যাকে যে অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ও যার অধীনে যে সম্পদ রয়েছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে অছিয়ত করে যান। ৮০৯ খ্রি: হারুন-অর-রশীদ খোরসান অভিযানে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর সঙ্গের ধনাগার ও সেনাবাহিনী মামুনের নামে উইল করে যান। কিন্তু খলীফা হয়ে আল-আমিন গুপ্তচর ও তাঁর উযির ফজল বিন রাবীর মাধ্যমে উক্ত সেনাবাহিনী ও ধনাগার বাগদাদে ফিরিয়ে আনেন। এতে মামুন তাঁর এই অন্যায় আচরণের প্রতি অসন্তুষ্ট হন।
আল-আমিনের ঈর্ষা
ব্যক্তিগত চরিত্র, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার জন্য আল-মামুন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের ও প্রজাদের নিকট জনপ্রিয় ছিলেন। মামুন প্রাচ্যের প্রদেশসমূহে রাজ কর মওকুফ করে দেন। এতে জনগণের ওপর তিনি প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। তাকে প্রাচ্যের
প্রজাগণ “তাদের ভগিনীর পুত্র” হিসেবে গ্রহণ করে। এর ফলে মামুনের প্রতি আল-আমিনের ঈর্ষার উদ্রেক হয়। তিনি মামুনের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার উপর ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠেন।
আরব-পারসিক দ্বন্দ্ব
আব্বাসীয় খিলাফতে এর প্রতিষ্ঠকাল হতে আরব-পারস্য দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। শাসনকার্যে উভয় জাতির লোকদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের সূচনা হয়। আল-আমিনের পরিবার, সমর্থকগণ ও তাঁর অমাত্যবর্গ সকলেই ছিলেন খাঁটি আরবীয়, অপরদিকে আল-মামুনের মাতা ও সমর্থকগণ ছিলেন পারসিক। তাই নিজ নিজ স্বার্থোদ্ধারে আরব ও পারসিক আমিরগণ এই গৃহযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে তোলে ।
আল-আমিনের আমোদপ্রিয়তা ও রাজকর্মে অবহেলা
আল-মামুন তাঁর দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর নিজ প্রদেশের শাসনপ্রণালীতে আত্মনিয়োগ করেন। অপরদিকে আল-আমিন ছিলেন অদূরদর্শী, আমোদপ্রিয়। তিনি তাঁর উযির ফজল বিন রাবীর হাতে সকল রাজকার্য অর্পন করে আমোদ-প্রমোদ ও আল-আমিনের কুশাসন এই কুশাসনকে ঘৃণা করতে শুরু করলো।
বিলাস ব্যসনে ডুবে রইলেন। তিনি রাজদরবারকে নর্তকী ও গায়িকার আবাসস্থলে পরিণত করেন। আল-আমিন তাঁর আমোদ-প্রমোদ ও বিলাসবহুল জীবনে ব্যাপক অর্থ অপচয় করতে লাগলেন। রাজশাসনের পরিবর্তে আমোদ-প্রমোদে অর্থব্যয়, তাঁর উযীর ফজল বিন রাবীর কুশাসনে সাম্রাজ্য ধ্বংসের মুখে আবর্তিত হচ্ছিল। প্রজাসাধারণ
ফজল বিন রাবীর স্বার্থপরতা
খলীফা আল-আমিনের উযীর ফজল বিন রাবী একজন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি ছিলেন। আল-আমিন ছিলেন দুর্বল চরিত্রের অধিকারী ও রাজশাসনে তাঁর কোন আগ্রহ ছিল না। তাই সকল ক্ষমতা উযীর ফজল বিন রাবীর হাতেই ন্যস্ত ছিল । তাই মামুনকে অপসারণ করে আল-আমিনকে নেপথ্যে থেকে রাজক্ষমতা হস্তগত করার গোপন ষড়যন্ত্রে তিনি লিপ্ত হয়ে ওঠেন।
মামুন ও কাসিমকে অপসারণ
খলীফা হারুন-অর-রশিদের ইচ্ছা অনুযায়ী আল-মামুন ছিলেন খোরসানের ও কাসিম ছিলেন কিন্নীসিরিনের শাসনকর্তা।
কিন্তু আল-আমিন তাঁর সমর্থকদের কুমন্ত্রণায় তাঁর উভয় ভ্রাতাকে তাদের পদমর্যাদা হতে বরখাস্ত করেন। মসজিদের
খুতবায় তাদের নাম উচ্চারণে নিষেধ করেন। এতে আল-মামুন আল-আমিনের উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
আল-আমিন কর্তৃক চুক্তিপত্রের শর্তভঙ্গ
আল-আমিন তাঁর পিতা কর্তৃক লিখিত চুক্তিপত্রের শর্ত লংঘন করেন। তিনি তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর ভ্রাতা মামুনের পরিবর্তে নিজ পুত্র মুসাকে ‘নাতিক বিল হক' উপাধি দিয়ে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিছুদিন পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্রকেও তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করেন। কাবাগৃহে রক্ষিত তাঁর পিতার মনোনয়নপত্র তিনি এনে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন।
মামুনের পুত্রদ্বয়কে হত্যার পরামর্শ
উযীর ফজল বিন রাবী, আল-আমিনকে বাগদাদে বসবাসকারী আল-মামুনের দুই পুত্রকে হত্যার পরামর্শ দেন। তবে আল- আমিন এই কথা কানে নেননি।
আল-মামুনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ :
খলীফা আল-আমিন তাঁর উজীরের পরামর্শে আল-মামুনকে প্রদত্ত ১,০০,০০০ দিরহাম ও তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এতে করে আল মামুন আল-আমিনের উপর অত্যন্ত ক্রুব্ধ হন ।
গৃহযুদ্ধের ঘটনা ও ফলাফল :
সীমান্ত বন্ধ : যুদ্ধ অনিবার্য বুঝতে পেরে আল-মামুন তাঁর রাজ্যের সীমান্ত বন্ধ করে দিলেন। সেখানে প্রহরী নিযুক্ত করলেন। আল-আমিনের কোন গুপ্তচর যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে কড়া নযর রাখলেন । আল-আমিনের সেনাবাহিনীর পরাজয় : আল-আমিন তাঁর সেনাপতি আলী ইবনে ঈসার নেতৃত্বে ৫০,০০০ সৈন্যের সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ৮১১ খ্রি: রাবী নামক স্থানে মামুনের বিখ্যাত সেনাপতি তাহির ইবনে হুসাইনের নিকট আলী ইবনে ঈসা ও তাঁর সেনাবাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আলী ইবনে ঈসা নিহত হন। এই দু:সংবাদ শুনে খলীফা
আল-আমিন তাঁর অপর সেনাপতি আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল প্রেরণ করেন। কিন্তু এই দলটিও তাহিরের নিকট পরাজয় বরণ করে।
মামুনের খলীফা উপাধি গ্রহণ : আল-মামুন খলীফা উপাধি গ্রহণ করলেন। আল-আমিনের প্রেরিত বেশ কয়েকটি বাহিনী
মামুনের সেনাপতি তাহির ও হারসামার নিকট পরাজয় বরণ করলো। সমগ্র ইরাক ও আরব মামুনের অধীনে চলে আসলো।
বাগদাদ অবরোধ : মামুনের সেনাপতি তাহির, হারসামা ও জুহাইর একত্রে বাগদাদ অবরোধ করেন। বাগদাদে অবস্থান করা নিরাপদ নয় দেখে খলীফা আল-আমিন তাঁর মাতা ও পরিবারবর্গসহ দজলার পশ্চিম তীরে অবস্থিত মদীনাতুল মনসুর দুর্গে আশ্রয় নেন ।
আল-আমিনের আত্মসমর্পন : অবশেষে আল-আমিন বৃদ্ধ ও অভিজ্ঞ সেনাপতি হারসামার নিকট আত্মসমর্পন করেন। কিন্তু রাত্রিকালে কয়েকজন উগ্র পারসিক কর্তৃক হতভাগ্য খলীফা আল-আমিন নিহত হন (৮১৩ খ্রি:)। এই মর্মান্তিক সংবাদে মামুন শোকে অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি হত্যাকরীদেরকে তৎক্ষনাৎ শাস্তিবিধান করেন। আল-আমিনের পুত্রদ্বয়কে আল- মামুন আপন পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। তারা বড় হলে নিজ নিজ কন্যাগণের সাথে তাদের বিবাহ দেন। মামুন আল- আমিনের পরিবারবর্গকে তাদের নিজ নিজ সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার দেন।
আল-মামুনের সফলতার কারণ আল-আমিনের ব্যক্তিগত চরিত্র ও কুশাসন : আল-আমিনের ব্যক্তিগত চরিত্র ছিল তাঁর পতনের জন্য বহুলাংশে দায়ী। রাজকার্যে অবহেলা, আমোদ-প্রমোদ ও হেরেমে আত্মনিয়োগ করে তিনি তাঁর চারিত্রিক ত্রুটিগুলোকে সকলের সামনে স্পষ্ট করে তোলেন। তাঁর এই শৃঙ্খলহীন জীবনের সুযোগ গ্রহণ করে তাঁর উযীর ফজল বিন রাবী সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন এবং প্রশাসন ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। অপরদিকে আল-মামুন ছিলেন প্রজাহৈতষী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নৃপতি। তাঁর শাসনের অধীনে প্রজাগণ সুখে শান্তিতে বসবাস করছিল। তাই এই চরিত্রগত পার্থক্যের দরুণ আল-আমিনের চেয়ে প্রজাদের নিকট আল-মামুনের গ্রহনযোগ্যতা বেশি ছিল ।
পারসিকদের শ্রেষ্ঠত্ব : আল-আমিন ও আল-মামুনের দ্বন্দ্ব ছিল মূলত আরব-পারিসক দ্বন্দ্ব। ধর্মীয় দিক থেকে এটি ছিল শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব। চারিত্রিক দুর্বলতা ও অনৈতিক ইসলামিক কর্মকাণ্ডের জন্য আল-আমিন খাঁটি সুন্নী-আরবদের সমর্থন হারান। অপরদিকে শিয়া সম্প্রদায় আল-মামুনকে তাদের ব্যাপক সমর্থন দান করে। তাই আল-আমিনের পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। আল-আমিনের সমর্থকগণের অযোগ্যতা ও স্বার্থপরতা : আল-আমিনের উযীর ও সমর্থকগণ অপেক্ষা আল-মামুনের উযীর ও সমর্থকগণ ছিলেন অধিক বিশ্বস্ত ও বিচক্ষণ। মামুনের খোরাসানের সেনাবাহিনী আল-মামুনকে তাদের ‘ভগ্নীরপুত্র’ মনে করতো, অপরদিকে আল- আমিন তাঁর সেনাবাহিনীকে অর্থ দ্বারা বশীভূত করেন এবং তারা ছিল স্বার্থপর ও অবিশ্বস্ত।
তাই এই গৃহযুদ্ধে আল-আমিনের পরাজয় ছিল আবশ্যক। অস্তিত্বের লড়াই : আল-আমিন আল-মামুনকে সকল দিকে থেকে বঞ্চিত করেন। তাঁর সাথে সকল প্রকার দুর্ব্যবহার করেন। তাঁর সম্পত্তি ও অধিকার হরণ করেন। এমনকি মামুনের পরিবারকেও হুমকির মুখে ফেলে দেন। তাই এই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতও ছিল আল-মামুনের নিকট অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। শেষ পর্যন্ত এই মনোবল আল-মামুনকে সফলতা দান করেছিল।
জনসমর্থনের অভাব : পারস্যবাসী আল-মামুনকে ব্যাপক সমর্থন দান করে। এতে তাঁর মনোবল ও সমর্থন বেড়ে যায়। অপরদিকে আল-আমিনের পেছনে কোন প্রকৃত জনসমর্থন ছিল না। যা তাঁর ব্যর্থতাকে ত্বরান্বিত করেছিল । অন্যায়ের উপর ন্যায়ের জয় : এই গৃহযুদ্ধ ছিল মামুনের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ। অপরদিকে আল-আমিনের জন্য তা ছিল কেবলই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে টিকে থাকার লড়াই । মূলত এটি ছিল অন্যায়ের উপর ন্যায়ের জয়লাভ ।
আল-মামুনের শাসন ব্যবস্থা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি -
আল-মামুনের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জানবেন ।
আল-মামুনের সময়ে বিদ্রোহ সম্পর্কে অবগত হবেন । আল-মামুনের সময়ে রাজ্যবিস্তার সম্পর্কে জানবেন।
মুখ্য শব্দ
জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, উচ্চাভিলাষী, শিয়া ইমাম, খারিজিগণ ও মাজেন্দ্রান
মার্ভে মামুনের অবস্থান
আল-মামুন ৭৫৮ খ্রি: পারস্যরমণী মারজিলের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ৮১৩ খ্রি: খলীফা আল-আমিন পরাজিত হলে মামুন খিলাফত লাভ করেন ও বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। খলীফা আল-মামুনের শাসনকালকে ২টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম ছয় বছর (৮১৩-১৯ খ্রি:) আল-মামুন খোরাসানের রাজধানী মার্ভে অবস্থান করেন এবং জ্ঞান- বিজ্ঞানের চর্চা করেন। এই সময় তাঁর বিশ্বস্ত উযীর ফজল বিন সাহল রাজকার্যে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন। পরবর্তী ১৪ বছর মামুন (৮১৯-৩৩ খ্রি:) স্বহস্তে শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
খলীফা আল-মামুনের বাগদাদে আগমন
ফজল বিন সাহল গৃহযুদ্ধে আল-মামুনকে সমর্থন ও ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করলেও, আল-মামুনের খিলাফত লাভের পর ফজল উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠেন। আল-মামুন নিজেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় ব্যস্ত রাখলে তিনি রাজক্ষমতার অপব্যবহার করেন। প্রধান সেনাপতি হারসামা খলীফাকে এই বিষয়ে অবগত করতে চাইলে ফজল গোপনে হারসামাকে হত্যা করেন । এর ফলে বাগদাদে হারসামার সমর্থকগণ বিদ্রোহ সৃষ্টি করে। অবশেষে শিয়া ইমাম আলী আল রিজা কর্তৃক প্রকৃত ঘটনা অবগত হয়ে খলীফা আল-মামুন বাগদাদের উদ্দেশ্যে মার্ভ ত্যাগ করেন। ফজল আততায়ীর হাতে নিহত হন।
খলীফা আল-মামুনের শাসনব্যবস্থা
৮১৯ খ্রি: খলীফা স্বহস্তে রাজক্ষমতা দখল করেন। তিনি প্রশাসনিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই ব্যাপারে তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ ও দূরদর্শী। তিনি হাসান বিন-সাহলকে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোকদের তিনি প্রশাসনে নিযুক্ত করেন। তিনি আলী পন্থীদের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করেন। আলীর বংশধরদের তিনি খিলাফতের অংশীদার করার উদ্দেশ্যে আব্বাসী বিরোধিতা সত্ত্বেও শিয়া অষ্টম ইমাম আলী আল-রিজাকে তাঁর পরবর্তী সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। কিন্তু ৮১৮ খ্রি: আলী আল রিযা মৃত্যুবরণ করলে তা বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়নি।
বিদ্ৰোহ দমন
খলীফা আল-মামুন তাঁর বিখ্যাত সেনাপতি তাহির ইবনে হুসাইনের পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনে তাহিরকে সিরিয়া মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তিনি সুশাসক ও উদার ছিলেন। আব্দুল্লাহ মেসোপটেমিয়া নসর উকায়লীর বিদ্রোহ দমন করেন ও তাকে বন্দি করে খলীফার নিকট প্রেরণ করেন। আবদুল্লাহ ইবনে তাহির পরবর্তীতে মিসরের বিদ্রোহীদের দমন করে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় ইয়েমেন ও খোরসানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ইবরাহীম ইয়েমেনে ও আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে খারিজিগণ খোরাসানে বিদ্রোহ সৃষ্টি করে। ইয়েমেনের বিদ্রোহ দমন করে আব্দুল্লাহ ইবনে তাহির খোরাসানের বিদ্রোহ দমন করেন।
রাজ্য বিস্তার
খলীফা আল-মামুনের সময়ে কোন উল্লেখযোগ্য রাজ্যবিজয় সংঘটিত হয়নি। তাঁর সেনাবাহিনী ভূমধ্যসাগরীয় ক্রীট ও সিসিলি অধিকার করে। এ সময় পারস্যের মাজেন্দ্রান নামক স্থানে বাবেক নামক জনৈক দস্যুর আবির্ভাব ঘটে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযান ব্যর্থ হলেও খলীফা স্বয়ং সৈন্য পরিচালনা করে এই অভিযানে সফলতা অর্জন করেন। খলীফার সেনাবাহিনী কতিপয় আফগান উপজাতিকে দমন করে তাদের অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়।
বুরানের সাথে বিবাহ
৮২৫ খ্রি: খলীফা আল-মামুন তাঁর প্রধানমন্ত্রী হাসান বিন-সাহলের কন্যা বুরানকে বিবাহ করেন। বুরান ছিলেন সর্বগুণে শ্রেষ্ঠা একজন রমণী। এই বিবাহের জাঁকজমকতা ও মহাসমারোহের কাহিনী আরব ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ব্যয়বহুল ঘটনা।
উত্তরাধীকারী মনোনয়ন
খলীফা আল-মামুন তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর যোগ্যতম ভ্রাতা আবু ইসহাক মুহাম্মদকে ‘মুতাসিমবিল্লাহ’ উপাধি দিয়ে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। খলীফা আল-মামুন ৮৩৩ খ্রি: তারসাসের অনতিদূরে বাদানদুন নামক স্থানে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
সারসংক্ষেপ:
খলীফা আল-মামুনের শাসনকাল ২টি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। মার্ভে ও বাগদাদের শাসনকার্য তাঁর শাসনতান্ত্রিক দক্ষতা প্রমাণ করে। প্রধানমন্ত্রী হাসান বিন সাহল তাঁর প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর সময়ে সংঘটিত বিদ্রোহসমূহ আব্দুল্লাহ ইবনে তাহির অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দমন করেন। তাঁর সময়ে খুব বেশি রাজ্যবিস্তার না ঘটলেও ক্রীট ও সিসিলি দ্বীপ তাঁর অধীনস্ত হয়েছিল। খলীফা আল- মামুন মৃত্যুর পূর্বে তাঁর যোগ্যতম ভ্রাতা আবু ইসহাক মুহাম্মদ মুতাসিম বিল্লাহকে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যান।
পাঠ-৮.১০
আল-মামুনের শাসন আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
জ্ঞান-বিজ্ঞানে খলীফা আল-মামুনের অবদানকে মূল্যায়ন করতে পারবেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে আল-মামুনের গৃহীত পদক্ষেপ ও কার্যাবলির বর্ণনা দিতে পারবেন।
আল-মামুনের সময়ে মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ জানতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
ইউরোপীয় নবজাগরণ, বায়তুল হিকমা, মাইলফলক, বিষুবরেখা, ধুমকেতু, চিকিৎসা, দূরবীক্ষণযন্ত্র, নৌ-কম্পাস আবিষ্কার ও ‘রায়হানী লিপি'
খলীফা আল মামুনের শাসনকাল ইতিহাসের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গৌরবজনক অধ্যায়। এই সময়ে আব্বাসীয় ইতিহাসের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য চরম শিখরে উপনীত হয়। আল-মামুনের রাজদরবার হয়ে ওঠে জ্ঞানী-গুণী, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, হাদিসবেত্তা ও মনীষীদের মিলনমেলা। খলীফা উদার হস্তে এই সকল গুণী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন।
ইসলামের গৌরবময় যুগ
খলীফা আল-মামুনের শাসনকাল ছিল ইসলামের ইতিহাসের গৌরবময় যুগ। এই যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ তাঁর পূর্ববর্তী সকল সময়কে ছাড়িয়ে যায়। তাঁর সময়ে ইসলাম ও বিশ্বের কৃষ্টি সভ্যতার ইতিহাসের সর্বাধিক মানসিক জাগরণের সূত্রপাত হয়। ইউরোপীয় নবজাগরণ ও আধুনিক সভ্যতা তারই সুচিন্তিত ভাবধারা ও দূরদর্শিতার ফল। এই প্রসংগে সৈয়দ আমীর আলী বলেছেন, Mamun's reign was unquestionably the most brilliant and glorious of all in the history of Islam.
শিক্ষা প্রসারে ভূমিকা
আল-মামুন মনে করতেন জনগণের সুখ-সমৃদ্ধি নির্ভর করছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতির উপর। তাই তিনি সাম্রাজ্যের সর্বত্র বহু স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এজন্য প্রচুর অর্থদান ও লাখেরায সম্পত্তি দান করেন। তিনি মসজিদ ও মাদ্রাসাকে ব্যাপকভাবে স্থায়ী আয়ের মধ্যে নিয়ে আসেন। চীন দেশের অনুকরণে কাগজ কল স্থাপন করেন।
অনুবাদ কার্যবলি
খলীফা আল-মনসুরের সময় প্রথম অনুবাদ কার্যের সূচনা হয়। খলীফা আল-মামুনের সময় তাঁর পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তিনি সিরিয়া, এথেন্স, এশিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশ হতে প্রাচীন গ্রন্থসমূহ সংগ্রহ করেন এবং তা বিখ্যাত পণ্ডিতদের দ্বারা অনুবাদ করেন। প্লেটো, এরিস্টটল, গ্যালেন, হিপোক্রিটাস প্রভৃতি দার্শনিকের গ্রন্থসমূহ আরবী ভাষায় অনুবাদ করা হয়। খলীফা লিউকের পুত্র কোস্টার উপর গ্রিক, সিরিয়া ও ক্যালদীয় ভাষায় গ্রন্থাবলি, মানকাহ এবং দুবান নামক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের উপর সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থসমূহ, ঈসা ও মুসার (আ.) উপর পারসিক ভাষায় লিখিত গ্রন্থসমূহ অনুবাদ করান। তিনি স্বর্ণমুদ্রার দ্বারা অনুবাদকদের পারিশ্রমিক দিতেন।
বাইতুল হিকমা প্রতিষ্ঠা
৮৩০ খ্রি: প্রতিষ্ঠিত বায়তুল হিকমা ছিল খলীফা আল-মামুনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কীর্তি। বাইতুল হিকমা (House of Wisdom) ছিল অনুবাদ কর্ম পরিচালনার জন্য একটি গ্রন্থাগার। এর মোট ৩টি শাখা ছিল। এগুলো হল- গ্রন্থাগার, শিক্ষায়তন ও অনুবাদ বিভাগ। হুনায়ন ইবনে ইসহাকের উপর এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। সকল পণ্ডিতগণ এই প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনভাবে গবেষণা করার সুযোগ পান। এই সকল মনীষীদের গবেষণার ফসল আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতাকে বিনির্মাণ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এ যুগে অনুবাদের পাশাপাশি বিজ্ঞানচর্চায় ও বিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল।
বিজ্ঞান চর্চা বিজ্ঞান গবেষণা ও চর্চায় এই যুগ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জন করে। যে সময় ইউরোপ অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল ঠিক সেই সময় ইয়াহিয়া-বিন-আল-মনসুর, সিন্ধ-বিন-আলী, খালিদ-বিন-আব্দুল মালিক প্রমুখ খ্যাতনামা গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ পৃথিবীর আকৃতি, গ্রহ, নক্ষত্র, বিষুবরেখা, ধুমকেতু ইত্যাদি বিষয়ের উপর মূল্যবান তথ্য আবিষ্কার করেন।
দূরবীক্ষণযন্ত্র ও নৌ-কম্পাস আবিষ্কার খলীফা আল-মামুনের সময়ে আবুল হাসান নামক একজন বৈজ্ঞানিক দূরবীক্ষণ যন্ত্র ও নৌ-কম্পাস আবিষ্কার করেন। এছাড়া মুসা-আল-খাওয়ারিজমী নামক বিখ্যাত গণিত ও ভূগোলশাস্ত্রবিদ এই যুগে আবির্ভূত হন। তাঁর রচিত “হিসাবুল জবর ওয়াল মুকাবালাহ” গণিত শাস্ত্রের একটি প্রাচীনতম গ্রন্থ ।
চিকিৎসা ও রসায়ন শাস্ত্ৰ
চিকিৎসা ও রসায়ন শাস্ত্রে এই যুগে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। উহান্না-বিল-মোসাওয়াহ চিকিৎসাশাস্ত্রে ও জাবির ইবনে হাইয়ান রসায়ন শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
ফারসি সাহিত্যে ধর্ম ও দর্শন
খলীফা আল-মামুনের সময়ে ফারসি সাহিত্য নবজীবন লাভ করে। ফারসি কবিতার জনক আবুল আব্বাস তাঁর সভাকবি ছিলেন। প্রসিদ্ধ হাদীস সংগ্রাহক ইমাম বুখারী, ঐতিহাসিক ওয়াকিদী ও ইবনে সাদ ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ইবনে হাম্বল ও দার্শনিক আল-কিন্দি তাঁর শাসনকালকে গৌরবান্বিত করেন।
হস্তলিপির বিকাশ
খলীফা আল-মামুনের সময়ে হস্তশিল্পের বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত হয়। এই সময়ে বিখ্যাত হস্তলিপিকার ছিলেন আবু রায়হান । তাঁর নামানুসারে তাঁর লিখন পদ্ধতিকে বলা হত ‘রায়হানী লিপি’ ।
মুতাযিলা মতবাদের প্রচলন
খলীফা আল-মামুনের সময়ে মুতাযিলা মতবাদ ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। খলীফা একজন উদার ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মাঝে
কোন ধর্মীয় গোঁড়ামী ছিল না। তিনি যুক্তিবাদী মুতাযিলা মতবাদকে গ্রহণ করেন ও রাজধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ
খলীফা আল-মামুনের সময় মুক্তবুদ্ধির চর্চা ছিল স্বীকৃত। বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, ইতিহাস সকল ক্ষেত্রেই এই যুগ ইসলামের ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছে। এই যুগ কেবল ইসলামের ইতিহাসেই নয়, সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অভূতপূর্ব জাগরণ ও উন্নতি বহন করেছিল। এটি ছিল মুসলিম ও ইসলামের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ (The Golden Age of Islamic Civilization)। এই যুগ ইতিহাসে 'Augustan Age of Islam নামেও পরিচিত। সকল সীমাবদ্ধতাকে পেরিয়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই যুগের অবদান ছিল অত্যন্ত ব্যাপক ।
সারসংক্ষেপ:
খলীফা আল-মামুনের রাজত্বকাল ছিল আব্বাসীয় ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য চর্চায় এই যুগ তাঁর পূর্ববর্তী সকল যুগকে ছাড়িয়ে যায়। এই যুগের অবদান কেবলমাত্র মুসলিমরাই গ্রহণ করেনি বরং সমগ্র ইউরোপের আধুনিক সভ্যতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক নবজাগরণ এই যুগের অবদানের ফসল। বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, শিল্প, রসায়ন, গণিত, ভূগোল এত উৎকর্ষ লাভ করেছিল যে, একে বলা হয় The Golden Age of Islamic Civilization |
পাঠ-৮.১১
আল-মুতাসিম বিল্লাহ, আল-ওয়াসিক ও আল-মুতাওয়াক্কিল
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
আল-মুতাসিম বিল্লাহর রাজত্বকাল সম্পর্কে জানতে পারবেন। আল-ওয়াসিক স্বল্প স্থায়ী শাসনকাল সম্পর্কে বলতে পারবেন।
কঠোর শাসক আল-মুতারয়াক্কিল সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনী, বুলকাওয়ারা, সামারাহ, বাবেক যুদ্ধ, পৃষ্ঠপোষক, আরবদের নীরো ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের
আল-মুতাসিম (৮৩৩-৮৪২) খ্রি
খলীফা আল-মামুনের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা আবু ইসহাক মুহাম্মদ আল-মুতাসিম বিল্লাহ উপাধি গ্রহণ করে বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনী গঠন
এই সেনাবাহিনীতে আরব ও পারস্য সৈন্যদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়, গোত্রতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তাই তিনি পারস্য সৈন্যদের প্রভাব হ্রাস করার জন্য তুর্কিদের নিয়ে নতুন সেনাবাহিনী গঠন করেন। এই তুর্কি সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী ।
রাজধানী স্থানান্তর
একপর্যায়ে তুর্কি বাহিনীর ক্ষমতা ও আধিপত্য এতো বৃদ্ধি পায় যে, খলীফা রাজধানী বাগদাদ হতে ৬০ মাইল উত্তর পশ্চিমে সামাররাতে (৮৩৬ খ্রি:) রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। এখানে তিনি বুলকাওয়ারা নামক রাজপ্রাসাদ, সেনানিবাস ও অশ্বের আস্তাবল নির্মাণ করেন।
বিদ্ৰোহ দমন
এই সময়ে ভারতীয় জাঠ উপজাতীয় লোকেরা ইরাকে বিদ্রোহ সৃষ্টি করে। খলীফা তাদের বিতাড়িত করেন। মাজেন্দ্রাণের বিদ্রোহী বাবেক পুনরায় বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে খলীফা তাঁর তুর্কি সেনাপতি আফসীনকে প্রেরণ করে বাবেক এর বিদ্রোহ দমন করেন । বাবেক যুদ্ধে নিহত হয় এবং মাজেন্দ্রানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাইজানটাইনদের সাথে যুদ্ধ
আল-মুতাসিমের শাসনকালে বাইজানটাইন শাসক থিওফিলাস জিবত্রা আক্রমণ করে। ৮৩৮ খ্রি: খলীফা তাঁর সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আনকারা নামক স্থানে বাইজানটাইনদের পরাজিত করেন, সম্রাটের জন্মভূমি এমোরিয়াম শহর ধ্বংস করে দেন। অবশেষে সম্রাটের সাথে খলীফা এক সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হন।
মাজিয়ান বিদ্রোহ
মাজিয়ান নেতা মাজিয়ার ৮৩৯ খ্রি: বিদ্রোহ সৃষ্টি করলে খলীফা আব্দুল্লাহ ইবনে তাহিরকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে মাজিয়ার পরাজিত ও নিহত হন। খলীফা তাঁর তুর্কি সেনাপতি আফসীনকে মাজিয়ারের সাথে গোপন সম্পর্ক থাকার অভিযোগে বন্দী করেন। পরে কারাগারে তাঁর মৃত্যু হয়।
চরিত্র ও মৃত্যু
ব্যক্তি জীবনে খলীফা আল-মুতাসিম বিল্লাহ নির্দয় ও কঠোর স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি দৈহিক ও মানসিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনিও খলীফা আল-মামুনের ন্যায় মুতাযিলা মতবাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ৮৪২ খ্রি: দীর্ঘদিন রোগে
আক্রান্ত থাকার পর খলীফা আল-মুতাসিম বিল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মৃত্যুর পূর্বে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আল-ওয়াসিককে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান ।
আল-ওয়াসিক (৮৪২-৪৭) খ্রিঃ
আল-মুতাসিম বিল্লার মৃত্যুর পর মনোনয়ন অনুসারে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আবু জাফর হারুন আল-ওয়াসিক বিল্লাহ উপাধি ধারণ করে বাগদাদের সিংহাসনে বসেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন উদার, শিক্ষিত, রুচিশীল এবং শিল্প, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। তিনি প্রায় ছয় বছর নির্বিঘ্নে রাজত্ব করেন। তাঁর রাজ্যে সমৃদ্ধি ব্যয় ছিল। বলা হয়ে থাকে এই সময় রাজ্যে কোন ভিক্ষুক ছিলো না। তিনি সঙ্গীতের ব্যাপক অনুরাগী ছিলেন। তিনি একশত রাগ ও সুর রচনা করেন। ৮৪৭ খ্রিঃ খলীফা আল-ওয়াসিক মৃত্যুবরণ করেন।
আল-মুতাওয়াক্কিল (৮৪৭-৬১) খ্রিঃ
সিংহাসনে আরোহণ :
আল-ওয়াসিকের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা আল-মুতাওয়াক্কিল ৮৪৭ খ্রি: সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর নিষ্ঠুরতার জন্য ঐতিহাসিকগণ তাঁকে আরবদের নীরো (Nero of the Arabs) বলে অভিহিত করেন।
গোড়া ধর্মান্ধ শাসক
খলীফা আল-মুতাওয়াক্কিল ছিল গোঁড়া সুন্নীপন্থী। তাই শিয়া ও মুতাযিলা মতবাদ অবলম্বনকারীদের প্রতি তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। মুতাযিলাদের সরকারি কার্য হতে বহিষ্কার ও অমুসলিমদেরকে রাজকার্যে নিযুক্ত হতে বিরত রাখে। বিখ্যাত তুর্কি সেনাপতি ঈতাখকে হত্যা করেন। কারবালায় ইমাম হুসাইনের মাযার ধ্বংস করেন।
সাম্রাজ্য বিভক্তিকরণ
রাজকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য আল-মুতাওয়াক্কিল তাঁর সাম্রাজ্যকে দু'ভাগে বিভক্ত করেন। পশ্চিমাঞ্চল তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আল-মুনতাসিরকে এবং পূর্বাঞ্চল অপর পুত্র আল-মুতাজকে প্রদান করেন। খলীফা তাঁর পুত্র মুতাযকে অধিক স্নেহ করতেন এবং তাঁর নামে মুদ্রাঙ্কন করেন।
মৃত্যু
খলীফা আল-মুতাওয়াক্কিলের পুত্রদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নীতি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আল-মুনতাসিরকে অসন্তুষ্ট করে তোলে। এর ফলাফল হিসেবে ৮৬১ খ্রি: তিনি কয়েকজন তুর্কি সেনাপতির সাহায্যে এক রাত্রিতে তাঁর পিতাকে হত্যা করেন এবং সিংহাসনে বসেন। এরপর থেকে পরবর্তী খলীফাগণ তুর্কি সেনাবাহিনীর হাতের পুতুলে পরিণত হয়।
সারসংক্ষেপঃ
খলীফা আল-মামুনের পর আল-মুতাসিম, আল-ওয়াসিম, আল-ওয়াসিক ও আল-মুতাওয়াক্কিল সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাদের শাসনকাল ছিল আব্বাসীয় শাসনের অনুজ্জ্বল দিক। তন্মধ্যে আল-মুতাসিমের রাজত্বকাল ছিল অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধশালী। আল-ওয়াসিক ছিলেন শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক এবং আরবদের নীরো বলে খ্যাত আল- মুতাওয়াক্কিল ছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামীতে আচ্ছন্ন এক শাসক। তাদের পরবর্তী শাসকগণ ছিলেন দুর্বল, রাজকার্যে অযোগ্য ও ক্ষমতাহীন। তারা ছিলেন তুর্কি সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল।
পাঠ-৮.১২
বুয়াইয়া বংশের উত্থান ও পতন
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি -
বুয়াইয়া বংশের পরিচয় ও তাদের উত্থান বর্ণনা করতে পারবেন । বুয়াইয়া বংশের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য শাসক সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।
বুয়াইয়া বংশের পতন সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ বুয়াইয়া বংশ, ১০ই মুহাররম, আল-আমির-উল-উমারাহ্, তাজ-উল-মিল্লাত, শাহানশাহ',
“আল-বিমারিস্তান আল-আযুদি’ ও ‘ইখওয়ানুস সাফা'
আব্বাসী শাসনামলে যে সকল আঞ্চলিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের শাসন সূচনা হয়, সে গুলোর মধ্যে বুয়াইয়া বংশ অন্যতম। এই বংশটি ছিল শিয়া মতাবলম্বী এবং আব্বাসীয় খিলাফতে এই বংশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব লক্ষ করা যায়।
বুয়াইয়াদের উত্থান
উৎপত্তি : আবু সুযা বুয়াইয়া ছিলেন এই বংশের একজন শক্তিশালী নেতা, যার নেতৃত্বে বুয়াইয়ারা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। তারা কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলে তাবারিস্তান ও গীলানের মধ্যবর্তী ভূ-ভাগ দাইলাম নামক স্থানে বসবাস করতেন। এই অঞ্চলে তখন সামানী বংশের শাসন কার্যকরী ছিল, এবং আবু সুযা বুখারার সামানীয় বংশের অধীনে চাকরি করতেন। আলী হাসান ও আহমদ নামক আবু সুযার ৩ পুত্র ছিল। এই বংশটি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
নামকরণ ও প্রতিষ্ঠা : সিরায হতে দাইলামী শাসকগণ ইরাক, ওয়াসিত দখল করে রাজদানী বাগদাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাগদাদে এই সময় আব্বাসীয় খলীফা ছিলেন মুস্তাকফী (৯৪৪-৪৬খ্রি:)। বাগদাদে এই সময় তুর্কি দেহরক্ষী বাহিনীর আধিপত্য বেড়ে যায়। খলীফা তুর্কি বাহিনীর হাতের পুতুলে পরিণত হন। সকল ক্ষমতা তুর্কিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। এই সময় বুয়াইয়ারা আহমদ এর নেতৃত্বে বাগদাদ উপকণ্ঠে হাজির হন এবং খলীফা আহমদ এর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। আহমদ খলীফার আহবানে সাড়া দিয়ে বাগদাদে প্রবেশ করেন। তুর্কি আল-আমির-উল-উমারা ও তুর্কি বাহিনী রাজধানী হতে পলায়ন করেন। আহমদ বাগদাদে খলীফাকে তাঁর সিংহাসনে পুন:প্রতিষ্ঠিত করেন। খলীফা তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আমীর-উল-উমারা হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং মুইয-উদ-দৌলাহ উপাধিতে ভূষিত করেন। এইভাবে মুইয-উদ-দৌলা বাগদাদে যে বংশ প্রতিষ্ঠা করেন তা তাঁর পিতার নামানুসারে নাম রাখেন বুয়াইয়া বংশ।
মুইয-উদ-দৌলা : (৯৪৫-৯৬৭) খ্রি: মুইয-উদ-দৌলা ছিলেন বাগদাদে বুয়াইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ধীরে ধীরে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হন এবং দুর্বল খলীফার উপর তিনি তাঁর প্রভাব ও কর্তৃত্ব খাটান। তিনি সাম্রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। তিনি সকল ক্ষমতা হস্তগত করেন, মুদ্রায় নিজের নাম অঙ্কিত করেন। খুতবায় খলীফার নামের সাথে তাঁর নামও উচ্চারিত হতো। খলীফা তাঁর অধীনে আশ্রিত ব্যক্তির ন্যায় ছিলেন। খলীফা রাজকোষ হতে দৈনিক ৫০০০ দিনার ভাতা হিসেবে পেতেন। খলীফার উপর তাঁর প্রভাব এবং প্রতিপত্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে মুইয-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। এই সংবাদে অবগত হয়ে মুইয-উদ-দৌলা খলীফাকে অন্ধ করে সিংহাসনচ্যুত করেন এবং আল- মুস্তাকফীর পুত্র আল-মুতীকে সিংহাসনে (৯৪৬ খ্রি:) বসান। খলীফা আল-মুতীর সাথে বুয়াইয়াদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল । মুইয-উদ-দৌলা নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন। ৯৫২ খ্রি: গ্রিকগণ মুসলিম সাম্রাজ্যে যুদ্ধ বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি শিয়া মতবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। ১০ই মুহাররমকে (কারবালার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা) শোক দিবস হিসেবে পালন করার নিয়ম প্রচলন করেন । ৯৬৭ খ্রি: মুইয-উদ-দৌলা মৃত্যুবরণ করেন।
ইজজুদ্দৌলাহ (৯৬৭খ্রি:) : মুইজ-উদ-দৌলার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বখতিয়ার ইজজুদ্দৌলাহ উপাধি নিয়ে আল-আমির- উল-উমারাহ পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু তিনি ছিলেন দুর্বলচিত্তের অধিকারী। শাসক হিসেবে তাঁর কোন যোগ্যতা ছিল না। তিনি তুর্কি বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলে তাঁর পিতৃব্য পুত্র আজদুদ্দৌলাহ তাকে উদ্ধার করেন এবং তাকে বন্দী করেন। পরবর্তীতে পিতা রুকনুদ্দীনের অনুরোধকে উপেক্ষা করে আজদুদ্দৌলাহ ইজজুদ্দৌলাহকে হত্যা করেন ।
আজদুদ্দৌলাহ (৯৬৭-৯৮৩) খ্রি: আজদুদ্দৌলাহ ছিলেন রুকনুদ্দৌলার পুত্র। ৯৩৬ খ্রিঃ আজদুদ্দৌলাহ ইস্পাহানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৯৬৭ খ্রি: ইজজুদ্দৌলাহকে নিহত করে আমীর-উল-উমারাহ পদ গ্রহণ করেন। পরবর্তী খলীফা তাকে তাজ-উল-মিল্লাত (জাতির মুকুট) উপাধিতে ভূষিত করেন। আজদুদ্দৌলাহ ছিলেন শ্রেষ্ঠ বুয়াইয়া শাসক। তিনি বুয়াইয়াদের ক্ষমতার চরম শিখরে আরোহণ করেছিলেন। তিনি বুয়াইয়া শাসকদের অধীনে এবং প্রতিষ্ঠিত ইরাক ও পারস্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোকে একত্রে করে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খলীফা তাকে ‘সুলতান' উপাধি প্রদান করেন। জুমুআর খুতবায় তাঁর নাম উচ্চারিত হয়। মুদ্রায় তাঁর নাম অংকন করা হয়। তাঁর প্রাসাদের দরজায় খলীফা দৈনিক তিনবার ঢোল পিটাবার জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন। তিনি উচ্চাভিলাষী শাসক ছিলেন এবং বুয়াইয়াদের মধ্যে তিনিই প্রথম ‘শাহানশাহ্’ উপাধি গ্রহণ করেন। আজদুদ্দৌলাহ নিজ কন্যার সাথে খলীফা আল-মুতীর পুত্র ও পরবর্তী খলীফা আত্তায়ী বিল্লাহর সাথে বিবাহ দেন। তিনি নিজেও খলীফার এক কন্যাকে বিবাহ করেন । আজদুদ্দৌলাহর সময়ে বুয়াইয়া সাম্রাজ্য কাস্পিয়ান সাগর হতে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তিনি প্রজাদরদী ও জনকল্যাণকামী শাসক ছিলেন। তিনি ছিলেন শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। তিনি নিজে সুশিক্ষিত ছিলেন। বিশ্বখ্যাত কবি আবু আলী, শরীফ ইবনে আলম ও আল-ফারসির মত জ্ঞানী-গুণী তাঁর রাজদরবার অলংকৃত করেন। তিনি বহু মসজিদ, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল নির্মাণ করেন। খাল-খনন ও সেচ ব্যবস্থার উন্নতি করেন। তাইগ্রীস ও ক্রূর নদীতে বাধ নির্মাণ করেন । বাগদাদে তিনি ‘আল-বিমারিস্তান আল-আজুদি' নামক একটি হাসপাতাল নির্মাণ করেন।
পরবর্তী বুয়াইয়াগণ : আদুদ্দৌলাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শামসুদ্দৌলাহ ‘শামস-উল-মিল্লাত' উপাধি নিয়ে আমীর-উল- উমারার পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁর ভাই শরাফউদ্দৌলাহ কর্তৃক পদচ্যুত হন। শরাফউদ্দৌলাহ ৯৮৩-৯৮৯ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ৯৮৯ খ্রি: তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র নসর বাহাউদ্দৌলাহ উপাধি নিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেন । ৯৯১ খ্রি: আব্বাসীয় খলীফা আল-কাদিরকে বাহাউদ্দৌলাহ আত্তায়ীর স্থলে সিংহাসনে বসান। খলীফা আল-কাদিরের সময়কাল হতে বুয়াইয়াদের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। সুলতানুদ্দৌলাহ(১০১২-১০২৪ খ্রি:) এবং ইমাদুদ্দীন (১০২৪- ১০৪৮ খ্রি:) খ্রিস্টাব্দে আমীর-উল-উমারার পদে আসীন হন। বুয়াইয়া বংশের শেষ সুলতান ছিলেন আমীর-উল-উমারাহ মালিক আর রহিম (১০৪৮-১০৫৫) সেলজুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা তুগ্রিল বেগ কর্তৃক বুয়াইয়াদের বিতাড়িত হওয়ার সাথে সাথে এই বংশের শাসনের অবসান ঘটে।
বুয়াইয়া বংশের পতনের কারণসমূহ :
শিয়া সুন্নী বিদ্বেষ : আব্বাসীয় খলীফা ছিলেন সুন্নী অপরদিকে বুয়াইয়া শাসকগণ ছিলেন শিয়া। তাই এই শিয়া সুন্নী দ্বন্দ্ব এই বংশের পতন ঘটায়। নিষ্ঠুরতা বুয়াইয়া বংশের অনেক শাসক নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন। তাদের নিষ্ঠুরতার জন্য ক্ষমতাহীন আব্বাসীয় খলীফা ও
প্রজাগণ তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বুয়াইয়াদের দুর্বলতা : আজদুদ্দৌলাহর পরবর্তী বুয়াইয়া শাসকগণ ছিলেন দুর্বলচেতা ও অযোগ্য। তারা বুয়াইয়া সাম্রাজ্যকে সুসংহত রাখতে সক্ষম হননি। তাই বুয়াইয়া বংশের পতন ঘটে। সেলজুক তুর্কিদের আক্রমণ : বুয়াইয়াদের দুর্বলতা, আত্মকলহ, গৃহযুদ্ধের সুযোগ গ্রহণ করে সুন্নী সেলজুক তুর্কিরা তুগ্রিল
বেগের নেতৃত্বে শেষ বুয়াইয়া শাসক মালিক রহীমকে পরাজিত করে বুয়াইয়াদের নিকট হতে ক্ষমতা কেড়ে নেয়। বুয়াইয়াদের অবদান : বুয়াইয়া আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা মুইযদুদ্দৌলাহ
বিদ্যানুরাগী ও শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। এই বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক আজ্দুদ্দৌলাহ এর সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা- সংস্কৃতি সর্বাধিক বিকশিত হয়। তিনি নিজেও একজন জ্ঞানী ও সুপণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন এবং গণিতশাস্ত্রে তাঁর দখল ছিলো। ঐতিহাসিক আল-মাসুদী, দার্শনিক আল-ফারাবী, আবু-নসর, কবি মুতানববী, ভাষাবিদ আলী-আল-ফারসী ও আবুল ফারা প্রমুখ মনীষীগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস ও সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখেন। এই সময় ‘ইখওয়ানুস সাফা' সম্প্রদায়
পাঠ-৮.১৩
সেলজুক বংশের উত্থান ও পতন
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি -
সেলজুক বংশের উত্থান সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন। সেলজুকদের রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনা করতে পারবেন।
সেলজুকদের পতন মূল্যায়ন করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
ঘুজ গোত্র, মধ্য এশিয়া, গজনীর বংশ, ‘সুলতান' উপাধি, ‘আতাবেগ' উপাধি, দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ, ‘জালালী পঞ্জিকা', গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়, এশিয়া মাইনর
সেলজুকগণ মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত ঘুজ গোত্রীয় লোক ছিলেন। সেলজুক বিন বাকায়িকের নাম অনুসারে এ বংশের নামকরণ হয় সেলজুক বংশ। তারা প্রাথমিককালে ছিল নিরক্ষর, অসভ্য ও অজ্ঞ। ৯৫৬ খ্রিঃ তারা সেলজুক বিন বাকায়িকের নেতৃত্বে দক্ষিণ ট্রান্স অক্সিয়ানার বোখারায় বসতি স্থাপন করে এবং সুন্নী ইসলাম মতাদর্শ ছিল। সেলজুকের পর তাঁর পুত্র পিগু আরসলান ও তাঁর পৌত্র তুগ্রিল বেগের নেতৃত্বে সেলজুকগণ মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। গজনীর সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মাসুদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সেলজুকের পৌত্র তুগ্রিল বেগ সেলজুকদের নেতৃত্ব দেন এবং মাসুদকে পরাজিত করে মার্ভ ও নিশাপুর দখল করেন। গযনীর বংশের ধ্বংসস্তুপের উপর সেলজুক বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১০৪৩ খ্রিঃ মধ্যে তুগ্রীলের নেতৃত্বে সেলজুকগণ বলখ, জুরজান, তাবারিস্তান, হামাদান, রাই, ইস্পাহান ও পারস্য দখল করে নেয়।
তুগ্রীল বেগ (১০৩৭-১০৬৩) খ্রিঃ
১০৫৫ খ্রিঃ আব্বাসীয় খলীফা কায়িম-বিল্লাহ বুয়াইয়া শাসকদের প্রতাপে অতিষ্ঠ হয়ে তুগ্রিল বেগের সাহায্য প্রার্থনা করেন । তুগ্রিল বেগ খলীফার আহবানে সাড়া দিয়ে বাগদাদে প্রবেশ করেন এবং ১০৫৫ খ্রিঃ শেষ বুয়াইয়া শাসক মালিক রহিমকে পরাজিত করে বাগদাদ দখল করেন। তুগ্রিল বেগ বাসাসিরি নামক তুর্কি নেতাকে পরাজিত ও নিহত করেন যিনি খলীফা আল-কায়িম বিল্লাহ কে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন। ১০৬০ খ্রিঃ খলীফা পুনরায় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। খলীফা তুগ্রিল বেগকে ‘সুলতান’ উপাধি দেন। তুগ্রিল বেগ বাগদাদে স্বয়ং উপস্থিত না থেকে তাঁর রাজধানী মার্ভ হতে শাসন কার্য পরিচালনা করেন । তুগ্রিল বেগ অত্যন্ত উদার, সরল, সাহসী ও যোগ্য সামরিক সংগঠক ছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর তুগ্রিল বেগকে জ্ঞানী, ধৈর্যশীল, দানবীর, অনাড়ম্বর ও বিদ্যানুরাগী বলে উল্লেখ করেন। মার্ভে ছিল তাঁর রাজধানী। তিনি যে নগর বিজয় করতেন সেখানে তাঁর বিজয়ের স্মৃতিস্বরূপ একটি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা স্থাপন করতেন। দীর্ঘ ২৫ বছর গৌরবে সাথে রাজত্ব করে ১০৬৩ খ্রি: তুগ্রিলবেগ মৃত্যুবরণ করেন।
আলপ আরসলান (১০৬৩-১০৭২) খ্রি:
তুগ্রিল বেগের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র আলপ আরসলান সেলজুক সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। সুলতান তুগ্রিলের সময় বাইজানটাইন সম্রাটের সঙ্গে যে সংঘর্ষের সূচনা হয়েছিল তা আলপ আরসলানের সময় চরমরূপ ধারণ করে। ১০৬০ খ্রি: আলপ আরসলান বাইজানটাইনদের কাপাডোসিয়া ও ফ্রিজিয়া হতে বিতাড়িত করেন। এরপর তিনি বাইজানটাইন অধিকার করে জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া দখল করেন। এতে ১০৭১ খ্রি: বাইজানটাইন সম্রাট ডায়োজিনিসিম রোমানাস ২,০০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন । আলপ আরসলান মাত্র ৪০,০০০ সৈন্যের সাহায্যে মালাজকার্দ নামক যুদ্ধক্ষেত্রে রোমানদের পরাজিত করেন। রোমান সম্রাট তাঁর কন্যার সাথে আলপ আরসলানের পুত্রের বিবাহ, সকল মুসলিমকে বন্দীদশা হতে মুক্তি প্রদান ও নিজের মুক্তিপণ হিসেবে ১০ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে সুলতানের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। আলপ আরসলান ১০৭৩ খ্রি: ইন্তিকাল করেন। তিনি মার্ভ হতে ইস্পাহানে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। আব্বাসীয় খলীফার সাথে তাঁর সুসম্পর্ক বজায় ছিল।
মালিক শাহ (১০৭২-১০৯২) খ্রিঃ
আলপ আরসলানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মালিক শাহ ‘জালালউদ্দিন' উপাধি নিয়ে ১০৭৩ খ্রি: সিংহাসনে আরোহণ করেন । মালিক শাহের রাজত্বকাল ছিল সেলজুক ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। তাঁর রাজত্বের শুরুর দিকে তাকে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহ দমন করতে হয়। নিজের ভ্রাতার তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই সময়ে আব্বাসীয় খলীফা ছিলেন মুকতাদির। তিনি একজন ব্যক্তি ছিলেন। মালিক শাহ তাঁর রাজধানী ইস্পাহান হতে বাগদাদে স্থানান্তর করে। একজন জ্ঞানী ও সুশাসক হিসেবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মালিক শাহ্ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর সময়ে সেলজুক সাম্রাজ্য চীনের সীমান্ত হতে ভূ-মধ্যসাগরীয় তীর পর্যন্ত এবং উত্তরে জর্জিয়া হতে দক্ষিণে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । তিনি শাসন সংস্কারে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। তাঁর সময়ে সাম্রাজ্যে সুখ-শান্তি বিরাজমান ছিল ।
খাজা হাসান নিযামুল মুলক
মালিক শাহ খাজা হাসান নিযামুল মুলককে পদে নিযুক্ত করে ‘আতাবেগ' উপাধি দেন। নিযামুল মুলক ছিলেন একজন পণ্ডিত ও মেধাবী এবং তাঁর কর্মদক্ষতা বিচক্ষণতার ফলেই সেলজুক শাসকদের মধ্যে মালিক শাহের রাজত্বকাল স্মরণীয় হয়ে আছে। এই প্রসংগে ঐতিহাসিক P.K. Hitti বলেন, ‘Nizamul-Mulk was probably, after Yahya Bermek, the ablest ministar and administrator, Asia has ever produced."
নিজামুল মুলক ছিলেন ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসের অলংকারস্বরূপ। তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রমাণস্বরূপ রাজ্যশাসন কাঠামোর উপর ‘সিয়াসাত নামা' নামক ফার্সি ভাষায় একটি মহামূল্যবান পুস্তক রচনা করেন। সুপণ্ডিত নিযামুল মুলক ১০৬৫-৬৭ খ্রি: বাগদাদে নিযামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন যা পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) এর মত দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন এই মাদ্রাসার একজন অধ্যাপক। শেখ সাদী এই মাদ্রাসার অন্যতম কৃতী ছাত্র ছিলেন এবং উমর আল-খৈয়াম নিযামুল মুলকের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। নিযামুল মুলকের পরামর্শে ১০৭৪ খ্রি: নিশাপুরে ৭০ জন জ্যোতির্বিদদের একটি সম্মেলন আহবান করেন এবং তাদের মাধ্যমে একটি পারসিক পঞ্জিকা সংস্কার করেন। এটি সুলতানের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘জালালী পঞ্জিকা'। মালিক শাহ নিশাপুরে একটি মান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়
মালিক শাহের রাজত্বের শেষ দিকে গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নিযামুল মুলকের সহপাঠি হাসান সাবাহ, যিনি পর্বতের বৃদ্ধ লোক (The Old Man of the Mountain) নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায় ফাতেমীয় খলীফার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং সাম্রাজ্যের সর্বত্র নৈরাজ্য ও ত্রাসের সৃষ্টি করে। তারা তরবারি ও বিষের সাহায্যে বহু রাজবংশীয় লোককে হত্যা করে। নিযামুল মুলকের উন্নতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে ১০৯১ খ্রিঃ গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় নিযামুল মুলককে হত্যা করে। তিনিই ছিলেন এই গুপ্তঘাতিক সম্প্রদায়ের প্রথম হত্যার শিকার। মালিক শাহ তাদের বিরুদ্ধে ২টি অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হন। অবশেষে ১২৫৬ খ্রি: মোঙ্গল নেতা হালাকু খান কর্তৃক গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিনাশ ঘটে ও তাদের প্রধান ঘাটি আলামুত দুর্গ বিধ্বস্ত হয়। মালিক শাহ প্রায় একুশ বছর রাজত্ব করে ১০৯২ খ্রি: মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
পরবর্তী সেলজুকগণ
মালিক শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পত্নী তুরখানের অনুরোধে খলীফা তাঁর শিশুপুত্র মাহমুদকে (১০৯২-৯৪) নাসিরুদুনইয়া ওয়াদ্দীন উপাধি দিয়ে সুলতানের পদে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু অচিরেই তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বরকিয়ারুক তাকে পদচ্যুত করেন ও রুকুনুদ্দীন উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। কিছুদিন পর তাঁর ভ্রাতা মুহাম্মদের সাথে তাঁর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বরকিয়ারুক পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন ও মুহাম্মদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সময় হতেই সেলজুক সুলতানদের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। সেলজুক সাম্রাজ্য পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ১১৯৪ খ্রি: পর্যন্ত সেলজুকগণ আব্বাসী খলীফাদের উপর প্রভাব বজায় রাখেন।
সেলজুকদের পতনের কারণসমূহ
যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাব : মালিক শাহ ছিলেন শ্রেষ্ঠ সেলজুক শাসক। তাঁর মৃত্যুর পর যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে সেলজুক বংশের পতন ঘটে।
নিজামুল মুলকের মৃত্যু : নিজামুল মুলকের ন্যায় মেধাবী ও যোগ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
পাঠ-৮.১৪
আব্বাসীয় বংশের পতন
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি -
আব্বাসীয় বংশের পতনের কারণসমূহ আলোচনা করতে পারবেন ।
আব্বাসীয় বংশের পতনের ঘটনার বিবরণ দিতে পারবেন।
আব্বাসীয় বংশের পতনের ফলাফল সম্পর্কে বলতে পারবেন ।
মুখ্য শব্দ
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশ, তুর্কি সেনাবাহিনী, গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়, হালাগু খান, খলিফা
মুস্তাসিম, বাগদাদ ধ্বংস
৭৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত আব্বাসীয় বংশ প্রায় ৫০০ বছর শাসন করে এবং ১২৫৮ সালে এর চূড়ান্ত পতন ঘটে । অষ্টম ও নবম শতকে এই বংশটি তার গৌরব বলয় বিস্তার করে ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণযুগের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই গৌরব রবি মোঙ্গল সেনাপতি হালাগু খানের হাতে অস্তমিত হয়।
আব্বাসীয় বংশের পতনের কারণসমূহ :
পরোক্ষ কারণ
কেন্দ্রিয় শাসনের দুর্বলতা : আব্বাসীয়দের প্রথম একশত বছরের শাসনকালকে গৌরবের যুগ বলা হয়। এ সময় আল- মনসুর, আল-মাহ্দী, হারুন-অর-রশিদ, আল-মামুন প্রমূখ খলিফারা যোগ্যতার সাথে কেন্দ্রিয় প্রশাসন যন্ত্রটি পরিচালনা করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে আল-ওয়াসিকের (৮৪২-৪৭ ) পরবর্তী খলিফাদের অযোগ্যতা, নৈতিক অবক্ষয়, জনকল্যাণমূলক কাজ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি নানা কারণে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে রাষ্ট্রের স্থায়ীত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। P. K. Hitti (গ্রন্থ: History of the Arabs) এর মতে, ৮২০ সালের দিকে যেখানে বাগদাদের খলিফার হাতে পৃথিবীর অধিকাংশ ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত ছিল, সেখানে একশ বৎসর পর উত্তরসূরীদের ক্ষমতা এতটাই কমে গেল যে, রাজধানীতেও এর বিন্দুমাত্র প্রভাব অনুভব করা যেতনা।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের উদ্ভব : খলিফাদের দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যে বিভিন্ন স্থানের আঞ্চলিক প্রধানগণ স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে এবং আব্বাসীয় সাম্রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে শুরু করেছিল। P. K. Hitti বলেন, “খিলাফত নামক দুর্বল ব্যক্তিটি যখন প্রায় মৃত্যুশয্যায়, তখন সিদেল চোরেরা দরজা খুলে সাম্রাজ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।” এ সময় আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমে তাহিরী, সাফ্ফারী, সামানি, বুয়াইদ, সেলজুক, গযনভী, ইদ্রিসী, আঘলাবী, তুলুনী, ইশিদ, জঙ্গি, হামানিদ ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের উদ্ভব ঘটে। এই আঞ্চলিক রাজবংশসমূহ কালক্রমে খিলাফত থেকে অলাদা হবার কারণে কেন্দ্রিয় শক্তি দুর্বল হতে থাকে।
তুর্কী সেনাদের দৌরাত্ম্য : খলিফা আল-মুতাসিম বিল্লাহ (৮৩৩-৪২) কর্তৃক গঠিত তুর্কী সেনাবাহিনী পরবর্তীতে আব্বাসীয় বংশের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই বাহিনী ক্রমে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে, আব্বাসীয় খলিফাগণ তাঁদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। খলিফাদের নিয়োগ ও পদচ্যুতির ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষমতা তাদের হাতেই থেকে যায়। তুর্কী সেনাদের দৌরাত্ম্যে খলিফা আল-মুতাসিম বিল্লাহ বাগদাদ হতে রাজধানী সামাররাতে স্থানান্তর করতে বাধ্য হন। কিন্তু সেখানে গিয়েও খলিফাদের বন্দী জীবন-যাপন করতে হত। তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ৫৬ বছর (৮৩৬-৯২) পর বাগদাদে আবার রাজধানী ফিরিয়ে আনা হয়। খলিফা মুস্তাকফী (৯৪৪-৪৬) তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বুয়াইয়াদের আমন্ত্রণ জানান। ফলে তুর্কীদের পরিবর্তে বুয়াইয়াদের প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর আবার সেলজুক ও খারিজম শাহের আধিপত্য খলিফাদের স্বাধীনভাবে শাসন করার ক্ষমতা হরণ করে।
জাতিগত দ্বন্দ্ব : জাতিগত দ্বন্দ্ব আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে বড় কারণ ছিল। আরবীয়, অনারবীয়, মুসলিম, নও-মুসলিম ও অমুসলিম যিম্মিদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিরাজ করছিল। আরবদের মধ্যে উত্তর আরবীয় ও
দক্ষিণ আরবীয়দের মধ্যে পুরানো বিভেদকামী মানসিকতা তখনও বজায় ছিল। পারসিক ও তুর্কী জাতি কখনও আরবীয় বা সেমেটিক জাতির সাথে মিলেমিশে একটি অখণ্ড সত্তায় পরিণত হতে পারেনি। সংস্কৃতিবান পারসিকরা অপেক্ষাকৃত কম সংস্কৃতিবান আরব শাসনের সাথে নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। ফলে জাতিগত কোন্দল আব্বাসীয় রাষ্ট্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে ফেলে।
ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা : জাতিগত দ্বন্দ্বের পাশাপাশি যোগ হয়েছিল ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব। শিয়া, সুন্নী, খারিজি, আশারিয়া, মুতাযিলা, গুপ্তঘাতক, কারামাতীয়, ঈসমাইলীয় ইত্যাদি ধর্মীয় মতবাদগুলি পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করত। বিশেষ করে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব আব্বাসীয় রাষ্ট্রের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর দ্বন্দ্ব কখনও কখনও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিত।
ত্রুটিযুক্ত উত্তরাধিকার নীতি : উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব আব্বাসীয় খিলাফতের ঐক্যের প্রতি ছিল হুমকি স্বরূপ। উত্তরাধিকারীদের অধিকার নিয়ে অন্তহীন দ্বন্দ্বের কোন মীমাংসা হয়নি; বরং এই দ্বন্দ্ব দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আরও দুর্বল করে দিয়েছিল। যখনই অসংখ্য ভাই-বোনদের মধ্যে একজন খলিফা হন, তখন খিলাফতের অন্যান্য দাবীদাররাও নির্বাচিত খলিফার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে খলিফাকে কার্যত অকার্যকর করে ফেলত।
অর্থনৈতিক সংকট : অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও এই বংশের পতনের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল। নতুন নতুন কর আদায় এবং কৃষি ও শিল্পের প্রতি ক্রমাগত অবহেলার কারণে মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। বারবার রক্তাক্ত সংঘর্ষে বহু মানুষের প্রাণহানী হয়। এছাড়া প্লেগ, গুটি বসন্ত, ম্যালেরিয়া, জ্বর ইত্যাদি মহামারিতে বহু মানুষের প্রাণহানী ঘটে। আরবীয় বর্ষপঞ্জিতে প্রথম চার হিজরি শতকে ৪০টি বড় ধরনের মহামারীর কথা লেখা আছে। জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় বহু আবাদী জমি পতিত জমিতে পরিণত হয়। ফলে অর্থের অভাবে সেনাবাহিনীর বেতন-ভাতা প্রদান, সেনাবাহিনী সম্প্রসারণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান বিঘ্নিত হয়।
প্রত্যক্ষ কারণ :
হালাগু খানের আক্রমণ : ১২৫৬ সালে মোঙ্গল সেনাপতি হালাগু খান গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযানে সাহায্য চাইলে খলিফা মুস্তাসিম (১২৪২-৫৮) তাতে কোন সাড়া দেননি। ১২৫৬ সালে হালাগু খান এককভাবে আক্রমণ চালিয়ে গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে সমূলে ধ্বংস করেন। গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযানে সাহায্য না করার অযুহাতে এবং খলিফা মুস্তাসিমের শিয়া উযির মুয়াহিদউদ্দীন আল-কামীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মঙ্গু খানের সেনাপতি হিসেবে হালাগু খান বাগদাদ আক্রমণ করেন।
বাগদাদ ধ্বংসের ঘটনা ও ফলাফল :
হালাগু খানের বাহিনী ১২৫৮ সালের জানুয়ারী মাসে বাগদাদে প্রবেশ করে। বাগদাদ অবরোধ করা হয়। তিনি নির্বিচারে বাগদাদের ২০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে ১৬ লক্ষকে হত্যা করেন। বাগদাদ নগরীকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস্তুপে পরিণত করা হয়। এখানে এতটাই হত্যাকাণ্ড চালানো হয় যে ইউফ্রেতিস ও তাইগ্রিস নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে যায়। খলিফাকে পরিবার পরিজনসহ হত্যা করা হয়। এর ফলে মুসলিম বিশ্ব কয়েক বছরের জন্য খিলাফত শূণ্য হয়ে যায়। বাগদাদের পতনের ফলে শুধু একটি সাম্রাজ্যেরই পতন হয়নি; বরং একটি সভ্যতারও পতন ঘটে। কারণ সমসাময়িক বিশ্বে বাগদাদ শুধু মুসলিম সভ্যতারই নয়, বিশ্ব সভ্যতারও প্রাণকেন্দ্র ছিল। আব্বাসীয় বংশের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আরবদের প্রাধান্য চিরতরে নি:শেষ হয়ে যায় এবং মূল খিলাফত ইতিহাসের অবসান ঘটে।
সারসংক্ষেপ: ১২৫৮ সালে আব্বাসীয় বংশের পতন ঘটে। শেষ যুগের খলিফাদের অযোগ্যতা, সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাব, তুর্কী সেনাবাহিনীর উত্থান, স্বাধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঞ্চলিক রাজবংশের উদ্ভব, বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি নানা কারণে এই বংশের অধ:পতন নেমে আসে। অবশেষে মোঙ্গল সেনাপতি হালাগু খান ১২৫৮ সালে বাগদাদ নগরী ধ্বংস সাধন করেন এবং এর ফলে আব্বাসীয় বংশের পতন ঘটে ।
পাঠ-৮.১৫
আব্বাসীয় সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
আব্বাসীয় সমাজের একটি রূপরেখা অঙ্কণ করতে পারবেন।
শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে আব্বাসীয় অবদান বর্ণনা করতে পারবেন ।
মুখ্য শব্দ
আব্বাসীয় সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি
আব্বাসীয় সমাজ ব্যবস্থা
আব্বাসীয় সমাজের স্তর বিন্যাস : আব্বাসীয় সমাজ ব্যবস্থা প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত ছিল : অভিজাত, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন শ্রেণী। খলিফা, তাঁর পরিবার পরিজন ও হাশেমী গোত্রের সদস্যবৃন্দ এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত হয় অভিজাত শ্রেণী। তারা সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেন। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ছিল বণিক, শিল্পী ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ। কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মেহনতি জনতা নিম্ন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নারী সমাজ : সমাজে নারীর উচ্চ স্থান ছিল । খলিফা আল-মাহ্দীর স্ত্রী খায়জুরান, কন্যা উলাইয়া, হারুন-অর-রশিদের স্ত্রী যুবাইদা প্রমূখ মহিয়সীরা আব্বাসীয় সমাজে তাদের কর্তৃত্ব প্রদর্শন করেন। নারীরা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ, বিচার কার্য সম্পাদন, সাহিত্য সভা বা আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ, কাব্য রচনা, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদিতে অবাধে অংশগ্রহণ করতে পারত।
দাস প্রথা : আব্বাসীয় সমাজে দাস-দাসীদের মানবীয় অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হতনা। আব্বাসীয় দরবারে ১০/১২ হাজার দাস-
দাসী থাকত। হেরেমে যেসব দাস থাকত তারা হত নপুংশক বা খোজা। অল্পবয়স্ক দাসদের নিয়ে গড়ে তোলা হত
গিলমান। দাসীরা নাচ-গান করত। দাসীদের মধ্য হতে অনেকে খলিফা ও অভিজাতদের উপপত্নী হত।
যিম্মি সমাজ : অমুসলিম বা যিম্মিদের সাথে আব্বাসীয়রা উদার ও মানবিক আচরণ করতেন। খ্রিস্টান, ইহুদি, সাবী, মাজুসী, জরথুস্ত্র সম্প্রদায় যিম্মিদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজদরবারে অমুসলিম জ্ঞান-গুণীরা সমাদৃত হতেন। বায়তুল হিকমাহ, রাজস্ব বিভাগ ও অন্যান্য দপ্তরে উচ্চপদে এমনকি উযির হিসেবে তারা গুরু দায়িত্ব পালন করত।
বিনোদন : আব্বাসীয় আমলে দাবা ও পাশা খেলার প্রচলন ছিল। খলিফা হারুন-অর-রশিদ প্রথম খলিফা যিনি দাবা খেলতেন এবং খেলাকে প্রশ্রয় দিতেন। তিনি ফ্রান্সের রাজা শার্লিমেনকে একটি দাবার বোর্ড উপহার দিয়েছিলেন। আউটডোর খেলার মধ্যে তীরন্দাজ প্রতিযোগিতা, পোলো খেলা, বল ও বল্লম ছোড়ার খেলা, ঘোড়দৌড় এবং শিকার উল্লেখযোগ্য ।
শিক্ষা ব্যবস্থা : উচ্চ শিক্ষায় মুসলিম দুনিয়ার প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হল বাইতুল হিকমাহ্। ৮৩০ সালে খলিফা আল- মামুন বাগদাদে এটা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে অনুবাদ কেন্দ্র, পাঠাগার ও গবেষণা-এই তিনটি বিভাগ ছিল। এ সময়ই বাগদাদে নির্মিত প্রথম হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হত। তবে উচ্চ শিক্ষায় প্রথম প্রকৃত প্রতিষ্ঠান ছিল নিযামুল মুলকের প্রতিষ্ঠিত নিজামিয়া শিক্ষায়তন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলি এটির অনুকরণেই গড়ে ওঠে। খলিফা আল মুস্তানসির (১২২৬-৪২) ১২৩৪ সালে চার মাযহাব শিক্ষাদানের জন্য মুস্তানসিরিয়াহ্ শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন । সংস্কৃতি
সাহিত্য ও কাব্য চর্চা : আব্বাসীয় আমলে আরবী ও ফারসি সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধিত হয়। ইউসুফ জোলেখা, লাইলী মজনু, আলিফ লায়লা ওয়া-লায়লা এ সময়ের বিখ্যাত সাহিত্য গ্রন্থ। কবিদের মধ্যে বাশার ইবনে বারদ, আবু-নওয়াস, আবু-তাম্মাম, আল-বুহতরি, আবু আল-আতাহিয়া ও আব্বাস বিখ্যাত ছিলেন।
ধর্মতত্ত্ব : আব্বাসীয় আমলে হাদীস চর্চা ব্যাপকতা লাভ করে। সিহাহ্ সিত্তাহ্ বা ৬টি বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ রচিত হয় এ সময় । এছাড়া ফিকাহ শাস্ত্রেরও বিকাশ ঘটে এ সময়। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে সমস্যার বাস্তবমূখী সমাধানের জন্য ৪ জন আইন প্রণেতা কুরআন, হাদীস ও ইজমার ভিত্তিতে ৪টি মাযহাব গড়ে তোলেন ।
ইতিহাস : আব্বাসীয় যুগে বহুমাত্রিক ও বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চর্চা আরও ব্যাপক রূপ লাভ করে। আল-ওয়াকিদী, হিশাম
আল-কালবী, মুহম্মদ ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, ইবনে সাদ, ইবনে আব্দুল হাকাম, আল-বালাযুরী, ইবনে কুতাইবা, দিনওয়ারী, আল-ইস্পাহানী, আল-তাবারী, ইবনে খাল্লিকান এ যুগের ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ভূগোল : ভূগোলের ক্ষেত্রে আল-তাবারী, আল-মাসুদী, আল-ইয়াকুত, আল-বালাযুরি, ইবনে হাওকাল, আল-বখি, আল- দিনাওয়ারি, ইবনে মিসকাওয়াই, আল-খাওয়ারিমি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। আল-খাওয়ারিমির ‘সুরাত আল-আরদ' এ বিষয়ে একটি মৌলিক গ্রন্থ। খলিফা আল-মামুনের সময় ৬৯ জন পণ্ডিতের মাধ্যমে একটি মানচিত্র তৈরি হয় যা
সৌরজগৎ ও পৃথিবী সম্পর্কে মুসলিমদের অঙ্কিত প্রথম মানচিত্র ।
দর্শন শাস্ত্র : দর্শন শাস্ত্রে আব্বাসীয়রা মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে। এ সময় আরবীয় দর্শন শাস্ত্রে গ্রিক ও পারসিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এ যুগের দার্শনিকদের মধ্যে আল-কিন্দি, আল-ফারাবী, ইবনে সীনা ও ইমাম আল-গায্যালী উল্লেখযোগ্য ।
চিকিৎসা বিজ্ঞান : চিকিৎসা বিদ্যায় আব্বাসীয়দের অবদান অনন্য। এ যুগের চিকিৎসকদের মধ্যে জিব্রিল ইবনে বখতিয়াসু, জাবির ইবনে হাইয়ান, ইবনে মাসাওয়াহ, সিনান ইবনে সাবিত বিন কুররাহ, আল-তাবারী, আল-রাযী, আল- মাযুসী, ইবনে সিনা বিখ্যাত ছিলেন। আল-রাযী ছিলেন বাগদাদের হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক। তাকে শল্য চিকিৎসার জনক বলা হয়। ইবনে সিনার ‘আল কানুন ফি আল-ত্বিব'কে বলা হয় চিকিৎসা বিদ্যার বাইবেল। নবম শতকে খলিফা হারুন-অর-রশিদের সময় বাগদাদে প্রথম হাসপাতাল নির্মিত হয় যার নাম হয় বিমারিস্তান।
জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতি :শাস্ত্র ও গণিত: জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিঃশাস্ত্র ও গণিতে সাধারণভাবে আরব এবং বিশেষ করে
আব্বাসীয়দের অবদান বিস্ময়কর । এ যুগের জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদদের মধ্যে আল-বাত্তানি, আল-বিরুনি, উমর আল-
খৈয়াম ও আল-খাওরিমি বিখ্যাত ছিলেন।
রসায়ন শাস্ত্র : জাবির ইবনে হাইয়ান ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রের জনক। তার রচিত গ্রন্থগুলো এশিয়া ও ইউরোপে রসায়ন শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হত। এছাড়া আল-রাযী রসায়ন শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
স্থাপত্য ও কারুকার্য, চিত্র শিল্প ও লিপিকলা : আব্বাসীয় আমলে সমাধিসৌধ, রাজ প্রাসাদ, অট্টালিকা, মসজিদ, হাসপাতাল, ঝর্ণা, বাগান, সরকারী হাম্মামখানা ও দুর্গ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামে অনুমোদন না থাকলেও এ যুগে চিত্রশিল্পের ব্যাপক চর্চা হয়েছে। আব্বাসীয় আমলে লিপিকলা গুরুত্বপূর্ণ শিল্প মাধ্যমে পরিণত হয়। এ সময় লিপিকলায় রায়হানী, মুহাককারা ও ইয়াকুতী পদ্ধতি যুক্ত হয়। সমাজে চিত্র শিল্পিদের চেয়ে লিপিকার বা হস্তাক্ষরবিদদের বেশি মর্যাদা ছিল। কারণ লিপিকাররা মূলত কুরআনের প্রতিলিপি লিখত। অন্যদিকে ইসলামে চিত্রশিল্প নিষিদ্ধ ।
সঙ্গীত চর্চা : আব্বাসীয় আমলে সঙ্গীত চর্চা বিকাশ লাভ করে। সিয়াত, ইব্রাহিম মওসিলি ও ইসহাক মওসিলি সে সময়ের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। ইসহাক মওসিলি ছিলেন ঐ যুগের শ্রেষ্ঠতম সঙ্গীতজ্ঞ। তাকে সঙ্গীতের ডিন বলা হয়।
সারসংক্ষেপ:
আব্বাসীয় সমাজ ব্যবস্থা প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত ছিল: অভিজাত, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন শ্রেণী। সমাজে নারীর উচ্চস্থান ছিল। দাসদের ও জিম্মিদের মানবীয় অধিকার ক্ষুণ্ন করা হত না। আব্বাসীয়রা শিক্ষা, সাহিত্য ও কাব্য চর্চা, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র, গণিত, স্থাপত্য, চিত্র ও লিপিকলায় তাদের মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়।